শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

উত্তরে কমছে পানি ডুবছে এবার ঢাকা

নদ-নদীতে পানি বাড়ছেই, দুর্ভোগের শেষ নেই বানভাসিদের

নিজস্ব প্রতিবেদক

উত্তরে কমছে পানি ডুবছে এবার ঢাকা

নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় প্লাবিত হয়েছে রাজধানীর নিম্নাঞ্চল। রাজধানীর খিলগাঁও আমুলিয়া এলাকা (বামে)। চাঁদপুর সদর উপজেলার বাখরপুরে বসতঘরে পানি ওঠায় বালিশসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছেন এক ব্যক্তি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পর বন্যা এবার আঘাত হেনেছে রাজধানী ঢাকায়। ঢাকার আশপাশের সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শাখা নদী ও সংযোগ খাল দিয়ে হু হু করে পানি ঢুকছে রাজধানীতে। নিম্নাঞ্চলগুলো ইতিমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। গতকাল অনেক উঁচু এলাকার রাস্তাঘাটও পানিতে তলিয়ে যেতে দেখা গেছে। তুরাগ ও বালু নদীর পানির চাপে রাজধানীর খালগুলোয় জমা দীর্ঘদিনের আবর্জনা ও নোংরা পানিতে সয়লাব অনেক এলাকা। নদ-নদী দুটি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এসব পানি নামতেও পারছে না। উল্টো প্রতিদিনই রাজধানীর নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও কিছু নদীর পানি এখনো বাড়ছে। আবার অনেক এলাকায় নদীর পানি কমলেও এখনো নামেনি বন্যার পানি। ফলে বানভাসিদের দুর্ভোগ এখনো যায়নি। এ ছাড়া এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ১৪টি নদ-নদীর পানি। গতকাল সকালেও পর্যবেক্ষণাধীন ১০১টি পানি সমতল স্টেশনের ৩৪টিতে পানি বৃদ্ধি পায়। রাজধানী ঘিরে থাকা তুরাগ নদের পানি মিরপুর পয়েন্টে গতকাল সকালে বিপৎসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার ও বালু নদীর পানি ডেমরা পয়েন্টে ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বুড়িগঙ্গার পানি এখনো বিপৎসীমার নিচে থাকলেও এক দিনে ১০ সেন্টিমিটার বেড়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের গত পরশুর বন্যা বুলেটিনে ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর আশপাশের নদ-নদীর পানি স্থিতিশীল থাকার পূর্বাভাস দেওয়া হলেও এক দিনের ব্যবধানে গতকাল তুরাগের পানি তিন সেন্টিমিটার, বালু নদীর পানি ৭ সেন্টিমিটার ও বুড়িগঙ্গার পানি ১০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায়। এতে স্লুইচগেটবিহীন খাল দিয়ে বন্যার পানি ঢুকে রাজধানীর অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ধর্মগঞ্জ এলাকায় বুড়িগঙ্গার পানির চাপে রাস্তা ভেঙে মুহূর্তের মধ্যে তলিয়ে গেছে ১৫০টি বাড়ি। ধসে গেছে একটি একতলা ভবন। বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার তিনটি ইউনিয়নের সহস্রাধিক ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের গতকালের তথ্যানুযায়ী, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, পদ্মা, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে। অপরিবর্তিত রয়েছে ঢাকার আশপাশের নদ-নদীর পানি।

এদিকে টাঙ্গাইল, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নাটোরসহ উত্তরের কিছু জেলায় বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। শরীয়তপুরে পদ্মার পানি আবারও বাড়তে শুরু করায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে জেলার মানুষ। সুরেশ্বর দরবার শরিফ রক্ষা বাঁধের ৫৫ মিটার পদ্মার গর্ভে হারিয়ে গেছে। চাঁদপুরে মেঘনার পানি বৃদ্ধিতে শহরের বিভিন্ন অঞ্চল, সদর উপজেলার চরাঞ্চলসহ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মেঘনার অস্বাভাবিক জোয়ারে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও রামগতির উপকূলীয় ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কোথাও কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে মাছের ঘের, পানিতে ডুবে মারা গেছে খামারের হাজার হাজার মুরগি। এ ছাড়া আগে থেকে বন্যা কবলিত এলাকাগুলোয় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট।

 ঘর-বাড়িতে পানি থাকায় এখনো মানুষ উঁচু সড়ক, বাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে। বন্যার পানিতে ফসল হারিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে কৃষক।

এদিকে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনেরই নিম্নাঞ্চলগুলো তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে। সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের ফকিরখালী এলাকার বেশিরভাগ বাড়িতে পানি উঠে গেছে। তলিয়ে গেছে অনেক রাস্তা। পথচারীরা কাপড় উঁচু করে রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে। স্থানীয়রা জানান, গতকালও যেসব রাস্তায় পানি ছিল না, আজ সেসব রাস্তায়ও পানি জমে গেছে। কালচে রঙের নোংরা পানি। অনেক মানুষ মালপত্র খাটের ওপর রেখে ঘর ছেড়ে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। একই অবস্থা দেখা গেল সাতারকুল ও দক্ষিণখান এলাকায়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৬, ৬৭, ৬৮, ৭০, ৭১, ৭৩, ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের নিম্নাঞ্চলগুলো তলিয়ে গেছে। পানির নিচে মান্ডা, কদমতলী, নলছাটা, দুর্গাপুর, তাম্বুরাবাদ, ধিৎপুর, খলাপাড়া, ঠুলঠুলিয়া, আমুলিয়া-মেন্দিপুর এলাকার নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়ি ও রাস্তা।

আমাদের বিভিন্ন জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো আরও তথ্য-

নারায়ণগঞ্জ : ফতুল্লার ধর্মগঞ্জ এলাকায় বুড়িগঙ্গার পানির চাপে রাস্তা ভেঙে মুহূর্তে একটি একতলা ভবন ধসে গেছে। ঘরে থাকা বাসিন্দারা কোনো রকমে জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়। তলিয়ে গেছে প্রায় ১৫০টি বাড়ি। অন্যদিকে শহরের ওপার বন্দর এলাকায় শীতলক্ষ্যার পানিতে নদীর পার্শ্ববর্তী বাজার তলিয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর পানির বৃদ্ধি পাওয়ায় নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার তিনটি ইউনিয়নের প্রায় এক হাজার ঘর-বাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানির স্রোতে দুটি এলাকার কয়েকটি নির্মাণাধীন ভবন ধসে পড়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, ফতুল্লার কাশিপুর ইউনিয়নের উত্তর নরসিংপুর এলাকার সামসুল আলম মোড় এলাকার রাস্তা ভেঙে ৫০০-৬০০ ঘর-বাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পরিবার পরিজন নিয়ে নারী-পুরুষ পানিতে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে। এনায়েতনগর ইউনিয়নের তিনটি এলাকার ৪০০-৫০০ বাড়িঘর পানির নিচে তলিয়ে গেছে। অনেকের ঘরে কোমর পানি।

লক্ষ্মীপুর : মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও রামগতির উপকূলীয় ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অন্তত ৪০ হাজার মানুষ। শতাধিক মাছের ঘের ও পুকুর পানিতে তলিয়ে গেছে। গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খামার পানিতে ডুবে গেছে। মারা গেছে পাঁচ হাজারের বেশি মুরগি। শত শত বসতঘরে পানি ঢুকে ক্ষতি হয়েছে আসবাবপত্র ও বিভিন্ন মালামালের। জোয়ারে ভেসে  গেছে চর ফলকন গ্রামের হাজী সিরাজুল ইসলাম, মো. সফিউল্যাহ, আজাদসহ এলাকার ২৫টি পুকুুরের মাছ।

শরীয়তপুর : গত দুই দিন ধরে পদ্মার পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্যায় শরীয়তপুরের জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও শরীয়তপুর সদর উপজেলা কয়েকটি ইউনিয়নের প্রায় ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। গত কাল ডামুড্যা ও গোসাইরহাট উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে অন্তত ২০ হাজার পরিবার নতুন করে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পদ্মা নদীর সুরেশ্বর পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় ১৫ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল সকালে বিপৎসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

চাঁদপুর : মেঘনার পানি বিপৎসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় শহরের বিভিন্ন অঞ্চল, সদর উপজেলার চরাঞ্চল ও হাইমচর উপজেলায় সেচ প্রকল্পের বাইরের এলাকাগুলো জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার অধিকাংশ বাড়ি ঘরে পানি প্রবেশ করেছে। রাস্তাগুলো পানিতে তলিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। চরাঞ্চলের লোকজন মাচা বেঁধে অবস্থান নিয়েছে।

মুন্সীগঞ্জ : পদ্মার পানি কমলেও হঠাৎ বাড়ছে মেঘনা-ধলেশ্বরী নদীর পানি। এতে করে মেঘনা-ধলেশ্বরী নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। গতকাল পদ্মার পানি কমে ভাগ্যকূল পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫২  সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অপরদিকে  মেঘনা ও ধলেশ্বরীর পানি বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জেলার পশ্চিমাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও অবনতি হয়েছে পূর্বাঞ্চলে।

টাঙ্গাইল : সব নদীর পানি কমে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। তছনছ হয়ে যাওয়া সংসার সাজাতে ব্যস্ত অনেকে। আবার অনেক এলাকা থেকে এখনো পানি নেমে যায়নি। টাঙ্গাইলের পূর্বাঞ্চলের বাসাইল, মির্জাপুর ও কালিহাতী উপজেলার অধিকাংশ ঘরবাড়ি এখনো পানিতে ভাসছে। এসব এলাকায় বন্যা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে। পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। খাদ্য সংকটে রয়েছে দুর্গত এলাকার মানুষ।

বগুড়া : সারিয়াকান্দি উপজেলায় কয়েক দফা বন্যায় কৃষকের ৬৬ কোটি ৯৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বগুড়ায় যমুনা নদীতে পানি কমেছে। পানি কমতে থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। দুই একটি পরিবার ঘরে ফিরেছে। কিন্তু, জমির পাট, আউশ ধান, ভুট্টা, আমন বীজতলা, মরিচ, রোপা আমন ও শাক সবজির আবাদ বন্যায় নষ্ট হওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে কৃষক। কৃষি দফতরের হিসাবে, বন্যায় কৃষকদের ৬৬ কোটি ৯৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকার ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর