স্বাভাবিকতায় ফিরছে দেশে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্প। করোনাকালে বড়দিন সামনে রেখে বৈশ্বিক ক্রেতারা সাড়া দিচ্ছেন। দ্রুত পণ্য নিতে তাগিদ দিচ্ছে অনেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। ক্রেতাদের সাড়া পেয়ে খুশি উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। ক্রেতারা দোকান খুলেছেন। বাংলাদেশি পোশাকপণ্যের প্রধান বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা স্বাভাবিকতায় ফিরছে। এতে পোশাকের চাহিদাও বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে দেশের অন্যতম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপের কর্ণধার ও শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বৈশ্বিক ক্রেতারা যেসব ক্রয়াদেশ ইতিমধ্যে স্থগিত বা বাতিল করেছিলেন, তা আবার ফিরিয়ে দিচ্ছেন। তবে মূল্য কমে যাচ্ছে প্রায় ১০ শতাংশ। বর্তমানে ৭৫ শতাংশ বুকিং আছে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর পর্যন্ত। আর নভেম্বর ও ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬০ শতাংশ অর্ডার থাকার তথ্য দিয়েছেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক এ সভাপতি। এফবিসিসিআইর আরেক সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এমপি বলেন, ‘করোনার চেয়ে আতঙ্ক আমাদের বেশি ক্ষতি করেছে। তবে ক্রেতারা দোকানপাট খোলা শুরু করেছে। এটা আশার দিক। বাংলাদেশের মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি আছে। এই শক্তির ওপর ভর করেই অতীতে যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ এগিয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক এ সভাপতি।
শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজের মতে, ‘করোনাভীতি দূর হলে বিক্রি বাড়বে। বড়দিন সামনে রেখে আগ্রহ বাড়ছে ক্রেতাদের। যদিও বিশ্বের অনেক দেশে নতুন করে লকডাউন দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যেই কিছু ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান খোলা আছে। আবার উৎপাদনশীলতা বাড়াতেও কারখানা খোলা দরকার। এতে উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি কর্মসংস্থানও রক্ষা হবে। আগামী ছয় থেকে আট মাস টিকে থাকার লড়াইয়ে জিতলে আমাদের অবিশ্বাস প্রবৃদ্ধি হবেই।’ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩ কোটি ২৪ লাখ ডলার। এ আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। যেখানে এপ্রিল-মে মাসে পোশাকের রপ্তানি প্রায় ৮৫ শতাংশ কমে আসে, সেখানে জুলাইয়ে তা ২ শতাংশে নেমে এসেছে। করোনায় স্থগিত ও বাতিল হওয়া পোশাকের অর্ডারগুলোও ফিরেছে। রপ্তানিও হয়েছে। নতুন অর্ডারও আসছে বলে জানিয়েছেন পোশাকশিল্প মালিকদের নেতারা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘স্থগিত ও বাতিল হওয়া অর্ডারগুলো গত জুলাইয়ে রপ্তানি করেছি। আর নতুন অর্ডার ছোট ক্রেতারা দিলেও বড় ক্রেতারা উল্লেখযোগ্য অর্ডার দিচ্ছে না। আবার নতুন অর্ডারের ক্ষেত্রে ক্রেতারা কম মূল্য বা অনৈতিক মূল্য দিচ্ছে। ফলে পোশাকশিল্প মালিকদের খরচই উঠছে না।’ বিজিএমইএর সহসভাপতি মো. মশিউল আজম সজল বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে শপিং মলগুলো চালু হওয়া আমাদের জন্য ইতিবাচক। আরও বেশি চালু থাকতে হবে।’ তবে এখনো ক্রেতাদের কাছ থেকে ইতিবাচক মাত্রার অর্ডার না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) সম্প্রতি প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ২৪৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এটি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯.৭৩ শতাংশ কম। অথচ ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২০ সাল শুরু হয়েছিল। পরের মাসেও প্রবৃদ্ধি হয় ১১ শতাংশ। মার্চ ও এপ্রিলেও রপ্তানি নেতিবাচক হয়নি। তবে মে মাসে গিয়ে রপ্তানি ১২ শতাংশ কমে যায়। এদিকে করোনার কারণে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২ হাজার ৭৮৮ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০.৩৭ শতাংশ কম। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ৮ হাজার ৩৮১ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে। মে পর্যন্ত মার্কিন বাজারে তৃতীয় পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ। আর চতুর্থ ভারত। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভারত ১৫৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। দেশটির রপ্তানি কমেছে ৩২.০৯ শতাংশ। ভারতের বাজার হিস্যা ৪.৬৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম প্রথম স্থানে ছিল। জুনে সেটি দখল করে নিয়েছে চীন। তবে দেশটির পোশাক রপ্তানি চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৪৯ শতাংশ কমে গেছে। বাণিজ্যযুদ্ধের সঙ্গে করোনাভাইরাস যোগ হওয়ায় এ দুর্দশা হয়েছে। এতে ছয় মাস শেষে যুক্তরাষ্ট্রে ৫৭৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছেন চীনের উদ্যোক্তারা।