শুক্রবার, ২৮ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

অনলাইনে রমরমা জুয়া নিঃস্ব হাজারো মানুষ

মাহবুব মমতাজী

অনলাইন জুয়া তীর খেলা ভারতের শিলং থেকে শুরু হয়ে আসে সিলেটে। এরপর নেত্রকোনা হয়ে ঢাকায়। ১৯৯০ সালের পর বাংলাদেশে এর বিস্তার ক্রমেই বাড়তে থাকে। ‘তীর টুডে ডটকম’-এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এ জুয়া। রমরমা এ জুয়ায় নিঃস্ব হয়েছে হাজারো মানুষ।

অনলাইন এই জুয়া চক্রের চার বাংলাদেশি এজেন্টকে ২৪ আগস্ট গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। এর মধ্যে শামিম মিয়া ও আবদুল আলীকে ঢাকা থেকে এবং এরশাদ মিয়া ও সোহাগ মিয়াকে নেত্রকোনা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ছয়টি মোবাইল ফোন, একটি রেজিস্টার খাতা, ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত সংখ্যাবিশিষ্ট চারটি চার্ট-সংবলিত ব্যবহৃত শিট এবং পাঁচটি অব্যবহৃত শিট জব্দ করা হয়েছে।

পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ জানায়, ৭০ থেকে ৮০ গুণ লাভের লোভ দেখিয়ে ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত জুয়ার সংখ্যা বিক্রি করা হতো। একজন একাধিক সংখ্যা কিনতে পারতেন। দিনে দুবার ড্র অনুষ্ঠিত হতো। এতে একজন বিজয়ী হয়ে লাভবান হলেও নিঃস্ব হয়ে পথে বসত হাজারো মানুষ। রাজধানীর যেসব এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের বেশি বসবাস, সেসব এলাকায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে চলত এই জুয়া খেলা। দিনমজুর, ট্রলিচালক, কয়লাশ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ীসহ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের টার্গেট করত জুয়ার এজেন্টরা। ছয় মাস ধরে ঢাকায় ওই জুয়ার সংখ্যা বিক্রি শুরু হয়। এ জন্য বাংলাদেশি এজেন্টদের কমিশন দেওয়া হতো। চক্রটি প্রতিদিন শুধু ঢাকা থেকেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। জানা গেছে, ১০ টাকায় ৭০০ টাকা পাওয়ার লোভে শিশু থেকে বয়স্ক পর্যন্ত অনেকেই এই জুয়ায় মেতে উঠতেন। রাজধানীর বস্তিগুলো টার্গেটে ছিল জুয়াচক্রের। তারা সবার আগে রাজধানীর গুলশানের কালাচাঁদপুরের এলাকাটি বেছে নেয়। সেখানে জুয়ার জন্য বিভিন্ন দলে ভাগ করে প্রতিটি দলে পাঁচ থেকে ছয়জন সদস্য নেওয়া হতো। এরপর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেখতে পাওয়া নির্ধারিত নম্বরে তীর লাগাতে পারলে জুয়ার এজেন্টরা টাকা দিয়ে দিত বিজয়ী একজনকে। বাংলাদেশ সময় বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে এবং রাত ১১টায় এই জুয়ার ড্র হতো। ইন্টারনেট সংযুক্ত অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোনে চরকির মতো একটি চাকা ঘোরে। এই চাকা লক্ষ্য করে তীর যে নম্বরে এসে লাগে, সেই নম্বরই বিজয়ী হয়। জুয়ার প্রতি টানে গড়ে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা আদায় করত চক্রটি। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, এই তীর খেলার জুয়া রবিবার বাদে ভারতের শিলং শহরে সপ্তাহে ছয় দিন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এদের এজেন্টরা বাংলাদেশে প্রতিদিন সকাল থেকে সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে ৯৯ টাকা পর্যন্ত টিকিট কেটে অপেক্ষা করতে থাকে। বিকাল ৪টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে একটি তীর এসে সংখ্যার মধ্যে লাগে। এ বিষয়ে সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) নাজমুল হক জানান, সিলেটের সীমান্তবর্তী ভারতের শিলং ও গোয়াহাটি এলাকা থেকে চালু হয় এই জুয়া খেলা। এরপর ধীরে ধীরে এটি ছড়িয়ে পড়ে সিলেটের বিভিন্ন প্রান্তে। সিলেটের অনেককে সর্বস্বান্ত করে এ জুয়া বিস্তার লাভ করে নেত্রকোনা জেলায়। নেত্রকোনা হয়ে শিলং তীরের থাবা এবার রাজধানীর বুকে- এমন খবরের ভিত্তিতে তথ্য ও প্রযুক্তি বিশ্লেষণ করে গুলশানের কালাচাঁদপুরের বাপ্পা মাস্টারের বস্তিতে অভিযান চালিয়ে জুয়ার এজেন্ট শামিম ও আবদুল আলীকে গ্রেফতার করা হয়।

 তাদের দেওয়া তথ্যে নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার বড়ুয়াপনা বাজার থেকে গ্রেফতার করা হয় এরশাদ ও সোহাগকে। এই এজেন্টরা দিনে ৭০ হাজার টাকার সংখ্যা বিক্রি করত। এর মধ্যে তাদের লাভ থাকত ৩০ হাজার টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, ভারতের শিলংয়ের জুয়াড়িরা বাংলাদেশে এজেন্ট নিয়োগ দেয়। বাংলাদেশি এজেন্টরা আবার বিভিন্ন এলাকায় তাদের সেলসম্যান নিয়োগ করে। এই সেলসম্যানরা সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন ধরনের লোভ দিয়ে আসক্ত করে। সেলসম্যানরা জুয়াড়িদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন রেখে বাকি টাকা ঢাকার এজেন্ট শামিম ও আবদুল আলীর কাছে পাঠায়। এরপর শামিম ও আলী তাদের কমিশন রেখে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠায় নেত্রকোনার এজেন্ট এরশাদ ও সোহাগের কাছে। নেত্রকোনা থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা চলে যায় সিলেটের জাফলংয়ে। জাফলং থেকে টাকা হুন্ডির মাধ্যমে যায় ভারতের শিলংয়ে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর