শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

কমছে পানি উন্নতি হচ্ছে পরিস্থিতির

নিজস্ব প্রতিবেদক

কমছে পানি উন্নতি হচ্ছে পরিস্থিতির

নদ-নদীর পানি কমে যাওয়ায় দেশে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এখন শুধু পদ্মার পানি গোয়ালন্দ স্টেশনে বিপৎসীমার সামান্য ওপরে রয়েছে। তবে এরই মধ্যে বন্যা কেড়ে নিয়েছে ২৫১টি প্রাণ। অধিকাংশ মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে। কিছু মৃত্যু হয়েছে সাপের দংশন, আঘাত, বজ্রপাত ও রোগের কারণে। এ ছাড়া ৩৩ জেলায় বন্যায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল হেল্থ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের প্রতিবেদন অনুসারে ৩০ জুন থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত বন্যাদুর্গত এলাকায় পানিতে ডুবে ২১০ জনের, বজ্রপাতে ১৩ জনের, সাপের দংশনে ২৫ জনের, ডায়রিয়ায় এক জনের এবং অন্যান্য কারণে দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যাকবলিত ৩৩  জেলায় ডায়রিয়া, চর্মরোগ, চোখের প্রদাহ, শ্বাসনালীর প্রদাহসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৭ হাজার ৩০১ জন। এর মধ্যে শুধু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৩ হাজার ১৭০ জন। চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১৬ হাজার ১৯৯ জন। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে মাদারীপুর জেলার মানুষ। ৩৩ জেলায় নানা রোগে আক্রান্ত ৫৭ হাজার ৩০১ জনের মধ্যে ২৬ হাজার ৪৫৮ জনই মাদারীপুর জেলার বাসিন্দা। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গতকাল সকালে শুধু পদ্মা নদীর পানি বিপৎসীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ২৪ ঘণ্টায় নদীটির পানি কমেছে ১০ সেন্টিমিটার। পূর্বাভাস মতে, সব প্রধান নদ-নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকবে। সেই হিসেবে আজ পদ্মার পানিও বিপৎসীমার নিচে চলে আসার কথা। এদিকে দীর্ঘদিন দুর্ভোগের শেষে পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারের হিসাবে এবারের বন্যায় ক্ষতি হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৭২  কোটি ৭৪ লাখ ৬২ হাজার ৭৬ কোটি টাকার। বন্যায় ও নদী ভাঙনে প্রায় চার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে গেছে ব্রিজ-কালভার্ট। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাস্তাঘাট। নিঃস্ব হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। হারিয়েছে ঘরবাড়ি। বন্যার পাশাপাশি নদীভাঙন কেড়ে নিয়েছে ভিটেমাটি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো ফসল হারিয়েছে কৃষক। মাছচাষি হারিয়েছে চাষের মাছ। বন্যার পানি নামলেও ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ও বাড়িঘরে কাঁদা থাকায় এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি ৩৩ জেলার ৫০ লক্ষাধিক মানুষ। ঘরে নেই খাবার। হাতে নেই টাকা-পয়সা। দূষিত পানিতে ডুবে অনুপযোগী হয়ে গেছে টিউবঅয়েল। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। দূষিত পানি পান করে ২৩ হাজারেরও বেশি মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। সরকার ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রাখলেও চাহিদার তুলনায় তা অপর্যাপ্ত। নানা সংকটের মধ্যেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষগুলো। কৃষক ফের হাল নিয়ে জমিতে নেমে পড়েছে। বন্যায় ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন জোড়া দিতে দিনভর ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে আবাদের পেছনে। তবে বন্যার পানি নামলেও নদী ভাঙনের কারণে এখনো অনেক এলাকার মানুষ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, এবারের বন্যায় কুড়িগ্রাম জেলায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪১৮ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে এই হিসাব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কয়েক দফা বন্যায় কাঁচা-পাকা সড়ক, বাঁধ ও ব্রিজ-কালভার্ট বিধ্বস্ত হয়েছে। ফলে ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্যাপরবর্তী যাতায়াতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে চরাঞ্চলসহ বন্যাদুর্গত এলাকার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামতের জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬২ কোটি টাকা। সরকারি হিসাবে কুড়িগ্রামের নয় উপজেলার ৫৬ ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আবাদি জমি ও আমন বীজতলা। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলায় সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮ দশমিক ৮০ কিলোমিটার পাকা সড়ক, ৪০১ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক, ২১ কিলোমিটার নদ-নদীর তীর রক্ষা বাঁধ, ছয়টি ব্রিজ ও ১০টি কালভার্ট। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৮৩ কিলোমিটার পাকা সড়ক, ৭৪৪ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক, ১১৬ কিলোমিটার নদ-নদীর তীর রক্ষা বাঁধ, ৫৭টি ব্রিজ ও ১৭১টি কালভার্ট। নতুন করে এসব সড়ক, বাঁধ ও ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি ও সংস্কারের সঙ্গে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত পাকা সড়কে কিলোমিটার প্রতি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বিপাকে রয়েছে এসব এলাকার মানুষ। কেউ কেউ বাঁশের সাঁকো বানিয়ে চলাচলের চেষ্টা করছেন। অনেক রোগী জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত হাসপাতালেও যেতে পারছেন না। কুড়িগ্রাম এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ আবদুল আজিজ জানান, বন্যায় জেলায় ১২৮ কিলোমিটার পাকা সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়াও ৩১টি ব্রিজ রিপ্লেসমেন্ট করতে হবে। আমরা তালিকা করে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়েছি। জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম জানান, জেলার সব বিভাগের সমন্বয়ে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এবারের বন্যায় কুড়িগ্রামে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪১৮ কোটি টাকা। বরাদ্দ পেলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাধ্যমে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করা হবে।

 

সর্বশেষ খবর