বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পুরোপুরিভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা যাচ্ছে না। জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি তাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ও নতুন একটি বিষয়। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া যতই দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ততই জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। গত ৩ বছরে ক্যাম্পগুলোতে জন্ম নিয়েছে ৯০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শিশু। কোনো কোনো দফতরের মতে এ সংখ্যা লক্ষাধিক। কারণ ২০১৭ সালের আগস্টে যখন রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এ দেশে আশ্রয় নিয়েছিল, সে বছরই প্রায় অর্ধলক্ষ রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নেয় এ দেশে। বর্তমানে সন্তানসম্ভবা রয়েছেন ৩০ হাজারের অধিক নারী। রোহিঙ্গাদের সহায়তায় নিয়োজিত ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ নারী। এদের মধ্যে ১৩ শতাংশ কিশোরী এবং ২১ শতাংশ গর্ভবতী ও প্রসূতি নারী ছিল। শিশুদের মধ্যে ৬-১৮ বছর বয়সী শিশুর হার ২৩ শতাংশ, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর হার ২১ শতাংশ এবং ১ বছরের কম বয়সের শিশুর হার ৭ শতাংশ। দিন দিন অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীনহারে বাড়ছে রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি মানতেই রাজি না রোহিঙ্গা নারীরা। তবে প্রশাসনের দাবি, জন্মনিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পে নানা কার্যক্রম চলছে। অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের দাবি, রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পে নানা কার্যক্রম চলছে। অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু-দ্দৌজা বলেন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর ও স্বাস্থ্যবিভাগ তাদের (রোহিঙ্গা নারী) বিষয়টি বোঝানোর কার্যক্রম চালাচ্ছে। রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষের জন্য তিন স্তরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কাজ চালানো হচ্ছে। সচেতনতাবৃদ্ধি, কনডম ব্যবহারে উৎসাহ, স্থায়ী ও অস্থায়ী জন্মনিরোধ পদ্ধতি ব্যবহার। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে প্রতি বছর নতুন জন্ম নেওয়া শিশুর হার ৩০ হাজার আর গর্ভবতী নারীর সংখ্যা ৩৫ হাজার। উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবদুল মান্নান জানান, রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসে, তখন প্রথম তিন মাসে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৪৮০ জন গর্ভবতী নারীর। তার মধ্যে বিভিন্ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব হয় সাড়ে পাঁচ হাজার শিশু আর বাকিগুলো ঘরেই প্রসব হয়। তবে এ নিয়ে নতুন করে সার্ভে করা দরকার বলে মনে করেন তিনি। কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের উপ-পরিচালক ডা. পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য জানান, ২০১৭ সালের আগস্টের পর থেকে পরবর্তী ২০ মাসে নবজাতকের সংখ্যা আমাদের হিসাব মতে লক্ষাধিক হয় না, কিন্তু বিভিন্ন জরিপ সংস্থা কীভাবে এক লাখ বলছে সে ব্যাপারে আমরা বলতে পারছি না। তিনি বলেন, আমাদের ২ শতাধিক কর্মী সপ্তাহে ২ দিন করে উখিয়া-টেকনাফে কাজ করছেন। বেশ কিছু সময় আমরা জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করার পর তারা সচেতন হয়েছে। আমরা এ পর্যন্ত ৭২ হাজার নারীকে ইনজেকশন দিয়েছি, ৭৬ হাজার নারীকে জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ দিয়েছি। এ ছাড়া তিন বছর মেয়াদি ২ হাজার ৪৯১ জন আর ১০ বছর মেয়াদি ইনজেকশন দিয়েছি ২ হাজার ১০০ জনকে। পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য্য বলেন, সরকারি-বেসরকারি ১২০টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে এসব রোহিঙ্গা নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে। ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ জন। অনেকে বেশি সন্তান মানেই বেশি ত্রাণ পাওয়া ও নিরাপত্তা মনে করে তারা। সরকারি ত্রাণের তালিকায় নাম দিতে পারলেই রোহিঙ্গাদের অনেকেই এখানে খাদ্যনিরাপত্তার আওতায় চলে আসা বলে ভাবছেন। উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা আবদুল মজিদ জানান, তার স্ত্রীর ৮ জন সন্তান রয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আল্লাহর নির্দেশে সন্তানাদি হয়, সেখানে ওষুধ খেয়ে নারীর গর্ভকে ‘কবর’ বানাব কি করে! ক্যাম্পগুলোতে স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা আরটিএম-এর ম্যানেজার নাসরিন আক্তার মনিকা বলেন, রোহিঙ্গা নারীরা এ ব্যাপারে আগের চেয়ে একটু সচেতন হচ্ছেন। নিজের শরীরের কষ্ট তারা বুঝতে পারছেন। কিন্তু পুরুষদের মাঝে একেবারেই আগ্রহ নেই। অনেক নারী পদ্ধতি গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসছেন। ইউএনএইচসিআরের জনসংখ্যা বিষয়ক রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ্দোজা নয়ন জানান, গত ২ বছরে ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৯১ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছে। তার মধ্যে ১ বছরের নিচে রয়েছে ৩১ হাজার শিশু। আর দুই বছরের নিচে রয়েছে ৬০ হাজার শিশু। জনসংখ্যা রোধ করতে ক্যাম্পগুলোতে নানা কার্যক্রম চলছে বলেও জানান তিনি।