রবিবার, ৩০ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

বিপৎসীমার নিচে নদ-নদীর পানি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিপৎসীমার নিচে নদ-নদীর পানি

কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলা সদরের সঙ্গে বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের যোগাযোগ রাস্তার আস্তারপাড় স্থানে ব্রিজটি বন্যার পানির তোড়ে ভেঙে যাওয়ায় মানুষ পড়েছে চরম ভোগান্তিতে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা বন্যার পর অবশেষে বিপৎসীমার নিচে নেমে এসেছে সব প্রধান নদ-নদীর পানি। সেই সঙ্গে পানি অব্যাহত হ্রাস পাচ্ছে। এতে দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে বন্যার পানি কমলেও নদীভাঙন অব্যাহত রয়েছে। সেই সঙ্গে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে মানবেতর দিনাতিপাত করছে বন্যাদুর্গতরা। ঘরবাড়ি মেরামত করতে না পারায় অনেকেই এখনো খোলা আকাশের নিচে রাত পার করছে। বৃষ্টি এলেই দুর্ভোগ চরমে উঠছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গতকাল সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১০১টি পর্যবেক্ষণাধীন পানিসমতল স্টেশনের ১৮টিতে পানি বাড়লেও কমেছে ৮১টির। অপরিবর্তিত ছিল দুটি নদীর পানি। তবে দেশের কোনো নদীর পানি এখন বিপৎসীমার ওপরে নেই। এর আগের দিনও পদ্মা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানিসমতল হ্রাস পাওয়ার এ প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে।

এদিকে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হতে লেগে যাবে দীর্ঘ সময়। সরকার ইতিমধ্যে জানিয়েছে, এবারের চার দফার বন্যায় সারা দেশে পাঁচ হাজার ৯৭২ কোটি ৭৪ লাখ ৬২ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতির এই পরিমাণ ১৯৯৮ সালের বন্যার চেয়ে কম। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৪৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৯৩ জন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ১৩ লাখ ৪৩ হাজার ১২১টি। ক্ষতিগ্রস্ত ঘর ৭ লাখ ৩৭ হাজার ৮২২টি। ক্ষতিগ্রস্ত বীজতলার পরিমাণ ২ লাখ ১১ হাজার ৬২৭ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত হ্যাচারি ৮ হাজার ৫২১ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮৩ হাজার ৪৫৭টি (সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ৫১টি)। ক্ষতিগ্রস্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ৩ হাজার ৩০৬টি। ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ লাইন ৪৬৩ কিলোমিটার। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ৫০৫ কিলোমিটার (সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ৩৭ কিলোমিটার)। বন্যায় ভেঙে গেছে কৃষকের মেরুদন্ড। নষ্ট হয়ে গেছে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো ফসল। ফের জমিতে ফসল ফলাতে লাঙল নিয়ে মাঠে নেমে গেছে কৃষক। সরকারের পক্ষ থেকে বীজ, সারসহ কৃষি উপকরণ দিয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে কৃষি বিভাগ। ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও বন্যাদুর্গত অসংখ্য মানুষের দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। পানিবাহিত নানা রোগ ও চর্মরোগে দিশাহারা দুর্গত এলাকার মানুষগুলো। ৩৩ জেলার ৫৭ হাজারের বেশি মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত। এদিকে বন্যার পানি নামলেও ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ও বাড়িঘরে কাদা থাকায় এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি অধিকাংশ মানুষ। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- রংপুর : বন্যায় এ অঞ্চলে ১৪ হাজার হেক্টর জমির ১৭৩ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এই অঞ্চলের পাঁচ জেলায় রোপা আমন, আউশ, পাট, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে আমনের চারা সংকটে পড়েছে কৃষক। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় ৬ হাজার ৪৪১ হেক্টর জমির পাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৬ হাজার ৪৪১ হেক্টর জমির আউশ, ১ হাজার ১৬৬ হেক্টর জমির আমন বীজতলা, ১ হাজার ২৪৪ হেক্টর জমির শাকসবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকদের পাশাপাশি কৃষি বিভাগও কাজ করছে। তারা ২২১ একর জমিতে নাবি জাতের বীজতলা করেছে। এ ছাড়া ভাসমান বীজতলা করেছে ৫০০ একর এবং ৩৬৮ জনকে ট্রের মাধ্যমে বীজতলা করে দিয়েছে কৃষি বিভাগ। এ ছাড়া ২৮ হাজার ২০ জনকে ১৪ প্রকার সবজি বীজ দেওয়া হয়েছে। তিন হাজার ৯০০ জনকে সার ও বীজ দেওয়া হয়েছে। কুড়িগ্রাম : বন্যায় এ জেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমন বীজতলার। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর নতুন করে আমন চারা লাগাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক। কৃষকদের বিনামূল্যে আমন বীজ প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি বিভাগ। কৃষকদের ঘাটতি কমাতে সরকারি উদ্যোগে ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি বীজতলা, ভাসমান বীজতলা ও বাড়ির ভিতর প্লেট পদ্ধতিতে বিকল্প বীজতলা তৈরিতে এগিয়ে এসেছে জেলা কৃষি বিভাগ। সরকারি প্রণোদনায় এসব বীজ বিনামূল্যে পেয়ে নতুন উদ্যমে মাঠে নেমেছেন অনেক কৃষক। জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, এ বছর বন্যায় কুড়িগ্রামে ১৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে। সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে ১১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার কৃষক। বিপর্যয় থেকে কৃষকদের ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের নির্দেশনায় সব ধরনের সহযোগিতার উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি বিভাগ। বন্যায় কুড়িগ্রাম জেলায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪১৮ কোটি টাকা। কাঁচা-পাকা সড়ক, বাঁধ ও ব্রিজ-কালভার্ট বিধ্বস্ত হয়েছে। ফলে ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্যা পরবর্তী যাতায়াতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে চরাঞ্চলসহ বন্যাদুর্গত এলাকার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামতের জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬২ কোটি টাকা। টাঙ্গাইল : কয়েক দফা বন্যায় ৪ হাজার ৬৮০ জন মৎস্য চাষি ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছে। জেলায় পাঁচ হাজার ৩২৭টি পুকুর ও মাছের ঘের তলিয়ে সব ধরনের মাছ ভেসে গেছে। এতে মাছ চাষিরা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে। জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, বন্যায় আনুমানিক ১ হাজার ২০৭ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে, যার দাম ১৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এদিকে ১ কোটি ৭৫ লাখ মাছের পোনা ভেসে গেছে, যার দাম ৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। এ ছাড়া অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া বলেন, এবারের বন্যায় টাঙ্গাইলে ২৭ কোটি টাকার ওপরে মৎস্য খাতের ক্ষতি হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিদের তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।

সর্বশেষ খবর