রবিবার, ৩০ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

হবিগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি

হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মিজবা উদ্দিন ভূঁইয়া এবং তার ভাই ইউপি চেয়ারম্যান নূরুল হক ভূঁইয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।  উপজেলার চারজন মুক্তিযোদ্ধা ২৩ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে এ অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযুক্ত অন্যরা হচ্ছেন ওই উপজেলার শরীফনগর গ্রামের আলী রেজা (৭০) ও বানিয়াচং উপজেলার মুরাদপুর ইউনিয়নের হোসেনপুর (বিথঙ্গল) গ্রামের ছিদ্দিক মিয়া (৭২)। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, লুটপাট, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ সত্তরের নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আজমিরীগঞ্জে নৌকা থেকে নামতে না দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন মেঘনা রিভার ফোর্সের কমান্ডার তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা মো. ফজলুর রহমান চৌধুরী জানান, কাকাইলছের ইউপি চেয়ারম্যান নূরুল হক ভূঁইয়া, তার ভাই মিজবা উদ্দিন ভূঁইয়া ও রাজাকার কমান্ডার আলী রেজাকে আটক করে তিনি একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এ সময় আসামিরা মালামাল লুটপাটের কথা স্বীকার করেছেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন স্থানে লুটপাট, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, হত্যাকা  সংঘটিত করেছেন। পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে কাজ করেছেন।

অভিযোগকারী আজমিরীগঞ্জের রসুলপুর গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ উদ্দিন জানান, তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা নূরুল হক ভূঁইয়া মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কাকাইলছেও ইউনিয়নের দাপুটে চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি পদাধিকারবলে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তার ভাই আজমিরীগঞ্জ উপজেলার বর্তমান আওয়ামী লীগ সভাপতি মিজবা উদ্দিন ভূঁইয়া ছিলেন নূরুল হক ভূঁইয়ার সহযোগী। অভিযুক্তরা কয়েকজনকে নিয়ে বানিয়াচং উপজেলার বিথঙ্গল গ্রামে হাজি ইউনুছ মিয়ার বাড়িতে হামলা করেন। এ সময় তারা ইউনুছ মিয়ার ছেলে আদম আলী ও ওয়াহাব মিয়া তালুকদারকে খুন করে হাজি ইউনুছ মিয়া ও হাজি সুলতান মিয়া তালুকদারের বাড়ি থেকে লাখ লাখ টাকার মালামাল লুট করেন। যাওয়ার সময় তারা বাড়িগুলোতে অগ্নিসংযোগ করেন। এ খবর পেয়ে গ্রামের লোকজন আদম আলী ও ওয়াহাব মিয়া তালুকদারের বাড়িতে এসে চারদিক ঘেরাও করলে রাজাকাররা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে পলু সরকারের ছেলে লক্ষ্মণ সরকার, আরাধন সরকার ও প্রমোদ রায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

মুক্তিযুদ্ধকালীন দাস পার্টির সদস্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, ‘মুসলিম লীগের নেতা হিসেবে ইউপি নির্বাচনে লড়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন নূরুল হক ভূঁইয়া। তিনি পদাধিকারবলে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার হওয়া সত্ত্বেও তাকে মারিনি। তার মায়ের কান্নায় বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন তিনি ও তার ভাই মিজবা উদ্দিন ভূঁইয়া আমাকেই এলাকাছাড়া করেছেন। কারণ এখন তাদের অনেক সম্পদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় লুটপাট করে তারা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।’ আজমিরীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মিজবা উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘সব অভিযোগ মিথ্যা। অভিযোগকারীরা বানিয়াচং উপজেলার বিথঙ্গল গ্রামের বাসিন্দা যুদ্ধাপরাধ মামলার কারান্তরীণ মধু মিয়ার মুক্তির দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। অথচ তার বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণসহ পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। একজন হিন্দু মেয়ে মামলা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। তাকে আমরা গিয়ে উদ্ধার করেছি।’ তিনি বলেন, ‘মূলত আমরা তার বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষী। ইতিমধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছি। তারা আমাদের সাক্ষ্য না দিতে বলেছিলেন। আর মধু মিয়াকে বাঁচাতেই তার কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে তারা মূলত আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন।’ কাকাইলছেও ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টা নূরুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘এগুলো ভুয়া অভিযোগ। এখানে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন, তারা মানুষের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন। তাদের মধ্যে আবার দুই নম্বর মুক্তিযোদ্ধাও আছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় দ্বন্দ্ব আছে। এলাকাগত দ্বন্দ্বের কারণেই মূলত আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন তারা।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান আবদুল হান্নান বলেন, ‘অভিযোগের কপি এখনো দেখিনি। অভিযোগ দায়ের করা হলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ অভিযোগ থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রচারণা চালাতে নৌকাযোগে আজমিরীগঞ্জে পৌঁছান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সঙ্গে ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও আবদুস সামাদ আজাদ। কিন্তু নূরুল হক ভূঁইয়া, তার ভাই মিজবা উদ্দিন ভূঁইয়া, আলী রেজা ও রফিক উদ্দিনসহ কয়েকজন সেখানে প্রচারণা চালাতে দেননি। নির্বাচনের সময় তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছেন। যুদ্ধকালে তারা কালোবাজারি ও লুটপাট করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। এলাকার মানুষের গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি জোরপূর্বক আদায় করে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যেতেন। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে সকালে শান্তি কমিটির সদস্য নূরুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে মিজবা উদ্দিন ভূঁইয়া, আলী রেজা, সিদ্দিক মিয়াসহ কয়েকজন বানিয়াচং উপজেলার বিথঙ্গল গ্রামে হাজি ইউনুছ মিয়ার বাড়িতে আক্রমণ চালান। তারা ইউনুছ মিয়ার ছেলে আদম আলী ও তার আত্মীয় ওয়াহাব মিয়া তালুকদারকে প্রকাশ্যে খুন করেন। এ সময় এলোপাতাড়ি গুলি করে একই গ্রামের লক্ষ্মণ সরকার ও প্রমোদ রায়কে হত্যা করেন তারা। হামলার সময় তাদের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন অভিযুক্তরা। এ ছাড়া তারা যুদ্ধের সময় বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেছেন। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান অভিযোগকারী মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ উদ্দিন, আক্কেল আলী, ইলিয়াছ চৌধুরী ও রমজান আলী।

সর্বশেষ খবর