রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান

করোনায় স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় পরিস্থিতির অবনতি, গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তথ্য

আলী আজম

কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান

রাজধানীর সবুজবাগ থানার রাজারবাগ বাগপাড়া দরবার গলিতে সিদ্দিকের প্রেসের সামনে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হন মো. জোব্বার আলী। এ ঘটনায় ৮ সেপ্টেম্বর নিহতের ভাই মো. সিদ্দিক বাদী হয়ে সবুজবাগ থানায় একটি মামলা করেন। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এ খুনে জড়িত বলে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে আসে। এরপর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে খুনি চিহ্নিত করা হয়। পরে ১৭ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে ইমন ও তার ভাই ইয়াছিনকে গ্রেফতার করা হয়। ইমন সুইচ গিয়ার দিয়ে জোব্বারকে খুন করে আর ইয়াছিন তাকে সহযোগিতা করে। ১৮ সেপ্টেম্বর ইমন এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ইয়াছিন খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। রাজধানীর উত্তরখান থানার রাজাবাড়ি খ্রিস্টানপাড়া রোডে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় উত্তরা পাললিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ শিক্ষার্থী সোহাগ। এ ঘটনায় ২৮ আগস্ট নিহতের বড়ভাই উত্তরখান থানায় একটি মামলা করেন। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এ খুনে জড়িত বলে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে আসে। পরে ২২ সেপ্টেম্বর দক্ষিণখানের মোল্লারটেক এলাকা থেকে সোহাগ হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত ‘দ্য বস’ গ্যাংয়ের টিম লিডার হৃদয় ও মাহবুবুল ইসলাম রাসেল ওরফে কাটার রাসেলকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১ এর সদস্যরা। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাব বলছে, গ্রেফতার হৃদয় ও রাসেল উত্তরখান এলাকার ‘রগকাটা’ গ্রুপেরও সদস্য। দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রাসেল হৃদয়ের নেতৃত্বাধীন কিশোর গ্যাং গ্রুপ দ্য বস বা হৃদয় গ্যাংয়ে কাজ করত। আর হৃদয় ষষ্ঠ শ্রেণির পড়াশোনা বাদ দিয়ে উত্তরায় একটি ওয়ার্কশপে কাজ করত। তার সঙ্গে রাসেল, নাদিম, সানি, মেহেদী, সাদ, সাব্বিরসহ এলাকার উঠতি বয়সের কিশোরদের সুসম্পর্ক থাকায় সবাইকে নিয়ে কিশোর গ্যাং ‘দ্য বস’ প্রতিষ্ঠা করে এবং সে নেতৃত্ব দেয়। এই গ্রুপের সদস্য প্রায় ১০/১২ জন। টেলিভিশনের বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সিরিয়াল দেখে এরা অপরাধ ও আত্মগোপনের বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কিশোর গ্যাং সদস্যদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। আর এতে হুমকির মুখে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। শুধু রাজধানীর ১০ থানা এলাকাতেই ৩২টি কিশোর গ্যাংয়ের ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ সদস্য অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে। এখনই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হতে পারে। সম্প্রতি সরকারের একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে ১২ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে আনতে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দেওয়া, জুমার খুতবায় কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন করা এবং কিশোরদের নিয়মিত কাউন্সেলিং করা। প্রতিবেদনটি এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৪ মাসে কিশোর সন্ত্রাসীদের হাতে ১৩টি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। এতে সমাজে অস্থিরতাসহ এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। গ্রেফতার করেও গ্যাং সদস্যদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় এবং কর্মজীবী কিশোররা তাদের কর্মস্থান হারিয়ে অধিকতর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ শুক্রবার সাতক্ষীরায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের চাপাতির কোপে চার আঙ্গুল হারিয়েছেন যুবলীগ নেতা মুজাহিদুর রহমান অন্তু। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে ২৫ মার্চ গার্মেন্ট ও শিল্প-কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। বর্তমানে কলকারখানা চালু হলেও দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এ কারণে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার চাপ নেই। আবার অনেক কিশোর করোনার কারণে কর্মসংস্থান হারিয়েছে। একদিকে স্কুল-কলেজ বন্ধ, অন্যদিকে অনেক কিশোর বেকার হয়ে পড়ায় তারা একত্রে পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে আড্ডা জমাচ্ছে। নিজেদের গ্রুপ ভারি করার জন্য তারা উঠতি বয়সী কিশোরদের দলে টানছে। পাড়া-মহল্লায় নারী ও কিশোরী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার পাশাপাশি এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। সামান্য কারণে খুনের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে তারা। শুধু ঢাকার ডেমরা, সূত্রাপুর, সবুজবাগ, খিলক্ষেত, কোতোয়ালি, উত্তরা পশ্চিম, তুরাগ, খিলগাঁও, দক্ষিণখান ও টঙ্গী থানা এলাকায় ৩২টি কিশোর গ্যাংয়ের ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ সদস্য বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। একই স্কুলে অধ্যয়নরত ও একই পাড়া-মহল্লায় বসবাসরত কিশোর-তরুণরা ফেসবুকসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাহারি ও চটকদার নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গ্যাং তৈরি করছে। মোড়ে মোড়ে আড্ডা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের মধ্যে ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি দেখার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া আধিপত্য বিস্তারসহ নানা কারণে কিশোর গ্যাং সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনে বলা হয়, কিশোর সন্ত্রাসীরা কখনো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, আবার কখনো বড়মাপের সন্ত্রাসীদের ছত্রছায়ায় অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালাচ্ছে। তাদের কারণে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে ছিনতাই, ছাত্রী অপহরণ, অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনায় কিশোরী-তরুণীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, শিশু-কিশোরদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে অভিভাবকদের আরও যত্নবান হওয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। পারিবারিক বন্ধন জোরদারের পাশাপাশি সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে- এ ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজ রাখতে হবে। খারাপ প্রকৃতির ছেলেদের সঙ্গে সন্তানকে না মেশার জন্য পরামর্শ দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেশি করে খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনার পাশাপাশি শিক্ষকদের মোটিভেশনাল ভূমিকা রাখতে হবে। গণমাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও অনুষ্ঠান পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র শিশু-কিশোরদের সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কিশোর-তরুণদের গ্যাং কালচারের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ কর্তৃক কিশোর গ্যাং নির্মূলে হটস্পট চিহ্নিত করে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় রাজনীতিবিদরা যেন কিশোরদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করতে না পারেন সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিং কার্যক্রম জোরদারসহ গ্যাং শনাক্তকরণে পাড়া-মহল্লায় অভিভাবকসহ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা যাতে লেখাপড়ার বাইরে অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যাপারে অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক জানান, করোনার সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়েছে। বেড়েছে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব। ঢাকায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ঢাকার বাইরে আগের মতো চলাফেরা করছে কিশোররা। বিভিন্ন বিষয়ে অধিক সময় দেওয়ায় বিরোধ বাড়ছে। ফলে হত্যা, ইভ টিজিং, ছিনতাই, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মারামারিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা। কিশোর গ্যাং স্থায়ী কালচারে পরিণত হতে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ উন্মুক্ত বা আকাশ সংস্কৃতি, ইন্টারনেট, তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রভাবিত হচ্ছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক আশ্রয়ও একটি কারণ। করোনার সময় অভিভাবকদের পরিকল্পনার অভাবে সন্তানদের কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। আর এই সুযোগে তার সন্তান নিজের মতো করে সময় ব্যয় করছে। পরে সে নিজেকে আলাদা করে উপস্থাপন করতে চায়। আর এটি করতে গিয়েই কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে বা নিজে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি করছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর