শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মেয়র লোকমান হত্যার চার্জশিটভুক্ত আসামি নৌকার প্রার্থী

নিজস্ব প্রতিবেদক

মেয়র লোকমান হত্যার চার্জশিটভুক্ত আসামি নৌকার প্রার্থী

আশরাফ হোসেন

গণমানুষের নেতা হয়ে উঠছিলেন নরসিংদীর প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেন। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত নরসিংদীর পৌর নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হন। শহর থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ছিল মেয়র লোকমানের সুনাম, যা ছড়িয়ে পড়েছিল দেশব্যাপী। নরসিংদীর উন্নয়ন আর মানুষের সেবায় যিনি ছিলেন  সারাক্ষণ ব্যস্ত সেই জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি, যিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছিলেন সেই খুনি আশরাফ হোসেন সরকারই পেলেন নরসিংদী পৌর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রতীক নৌকা। বুধবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভায় নরসিংদী পৌরসভায় মেয়র পদে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমানকে যার পরিকল্পনায় হত্যা করা হয়েছিল সেই খুনি আশরাফকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় জেলা এবং শহর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসগঠনের নেতা-কর্মী-সমর্থকসহ সাধারণ মানুষ হতবাক, ক্ষুব্ধ। ওই ঘটনার পর গতকাল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে আশরাফ হোসেন সরকারের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ, পৌর আওয়ামী লীগসহ সব সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সম্পাদক। চিঠিতে তারা তৃণমূলের সিদ্ধান্ত বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের ছোট ভাই বর্তমান মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. কামরুজ্জামানকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, জনপ্রিয় নেতা ছিলেন লোকমান হোসেন, নরসিংদীর উন্নয়নে যার বিশাল ভূমিকা। জামায়াত-বিএনপির অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন যিনি আওয়ামী লীগের সেই প্রিয় নেতা লোকমান হত্যার খুনি কীভাবে পৌর নির্বাচনে মনোনয়ন পান বুঝি না। যিনি একাধিক মামলার আসামি, দলীয় কর্মকান্ডের সঙ্গে যার এক যুগ ধরে সম্পর্ক নেই সেই ব্যক্তির মনোনয়ন দলীয় নেতা-কর্মীসহ তৃণমূলের সমর্থকরা মেনে নিতে পারছেন না। নেতা-কর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সব সময় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ আর দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় আর সেই আওয়ামী লীগ থেকে যদি আশরাফের মতো খুনিরা পুরস্কৃত হয় তাহলে শুধু নরসিংদীবাসী নয়, সারা দেশের মানুষের জন্য দুঃসংবাদ। বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে ভুল তথ্য দিয়ে এ মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ করছেন তারা। জানা গেছে, জেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে তিনজন প্রার্থীর নাম পাঠানো হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রে। ১ নম্বরে ছিল নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান মেয়র কামরুজ্জামান কামরুলের নাম, যিনি প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের ছোট ভাই। তালিকায় ২ নম্বরে ছিলেন শহর আওয়ামী লীগের সাধরণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন বাচ্চু আর ৩ নম্বরে শহর আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান। কিন্তু আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মকান্ডে ছিল না যার কোনো সম্পৃক্ততা, যিনি দলের কোনো পদেও ছিলেন না দীর্ঘদিন সেই বিতর্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও আছে সেই আশরাফ সরকার নৌকার মনোনয়ন পাওয়ায় দলের ভিতরেই তীব্র অসন্তোষ চলছে। আশরাফ সরকারের মনোনয়ন বাতিল করে দলের যোগ্য ও তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রার্থী দেওয়ার জন্য নেত্রীর কাছে দাবি জানান দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে বলছেন, আমরা আওয়ামী লীগ মনেপ্রাণে করি। আর একজন জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতার খুনির জন্য মানুষের কাছে ভোট চাইতে যাব কীভাবে? যার হাতে লোকমানের রক্তের দাগ লেগে আছে তার হাতে হাত মেলাব কীভাবে? আমাদের নেত্রী এ বিষয়টি বিবেচনা করে লোকমানের ভাই কামরুজ্জামান কামরুলকে মনোনয়ন দিলে নরসিংদীবাসী নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করবে। নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পীরজাদা কাজী মো. আলী বলেন, ‘লোকমান হত্যার বিচার দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। সেই কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আমি এখনো দায়িত্ব পালন করছি। এখন সেই আমি কী করে লোকমানের খুনি আশরাফ সরকারের জন্য মানুষের কাছে ভোট চাইতে যাব? আমাদের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা এ ঘটনায় ধিক্কার দিচ্ছেন, কোনোভাবেই মেনে নিচ্ছেন না। আশরাফের মনোনয়ন বাতিল করে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়ে নেত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছি, আশা করছি তিনি আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষের চাওয়া পূরণ করবেন।’ নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন বাচ্চু বলেন, ‘আশরাফ হোসেন সরকারের মতো একজন খুনিকে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ায় আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী হতবাক, ক্ষুব্ধ। তার এ মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আমরা কেন্দ্রেও চিঠি দিয়েছি। শুধু খুনিই নয়, যিনি গত ১০ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগের কোনো দলীয় পদে নেই, কোনো কর্মসূচিতেও দেখা যায়নি, জনবিচ্ছিন্ন খুনি সেই আশরাফ কীভাবে মনোনয়ন পেলেন, আমরা ভেবে পাই না।’ জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান শামীম নেওয়াজ বলেন, ‘আমার ভাইকে যিনি হত্যা করলেন, আদালতে স্বীকারোক্তিও দিলেন, চার্জশিটও হলো সেই খুনি এখন নৌকা প্রতীক পেলেন। আর আমি এখন জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে তার জন্য আমার ভোট চাইতে হবে! আমাদের নেত্রী নিশ্চয়ই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন।’ জেলা শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘শুধু লোকমান হত্যার আসামিই নয়, একাধিক মামলার আসামি এই আশরাফ সরকার। তিনি ২০ বছর ধরে দলের সঙ্গে নেই। এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে মেনে নিতে পারি না।’

সর্বশেষ খবর