শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

নান্দনিক রূপে তিনশ বছরের মসজিদ

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

নান্দনিক রূপে তিনশ বছরের মসজিদ

প্রতি শুক্রবার হাজারো মুসল্লি আসেন মসজিদে। কিন্তু নামাজ আদায় করতে হয় মাঠে, সড়কে। পুরো এলাকায় তৈরি হয় ‘তিল ঠাঁই আর নাহিরে অবস্থা’। তবুও তৃপ্তির ছাপ থাকে সবার মাঝে। গাদাগাদি করে নামাজ পড়ার ক্লান্তিবোধ দেখা যায় না কারও মধ্যে। এমনি অবস্থায় স্থান সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৈরি করা হবে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। বহুমাত্রিক পরিকল্পনায় নির্মিত হবে কমপ্লেক্স। সম্পূর্ণ নতুন অবয়ব দেওয়া হবে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এ মসজিদকে। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নয়নাভিরাম রূপ পাবে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর খরণদ্বীপ ইউনিয়নের তিন শত বছরের ঐতিহ্যবাহী শ্রীপুর ‘বুড়া মসজিদ’। জানা যায়, স্থানীয় উদ্যোগে তিন শত বছরের পুরনো বুড়া মসজিদটি নতুন রূপ দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রাথমিক সব পরিকল্পনা শেষ। তৈরি হয়েছে চারতলা বিশিষ্ট মসজিদের প্রস্তাবিত নকশা ও মাস্টারপ্ল্যান। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ কোটি টাকা। তৈরি করা হবে মসজিদ কাম কমপ্লেক্স। একসঙ্গে  নামাজ আদায় করতে পারবেন তিন হাজার মুসল্লি। মসজিদের মোতাওয়াল্লি ও বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আছিয়া খাতুন বলেন, মসজিদটি ৩০০ বছরের পুরনো। এখন অনেকটা জরাজীর্ণ। অবকাঠামো অনেক পুরনো। বর্ধিত অংশও পাঁচ বছর পূর্বের। সময়ের বাস্তবতায় মসজিদটির নতুন অবয়ব দেওয়া জরুরি। তাই নতুন করে আধুনিক নির্মাণ স্থাপত্যশৈলীর মাধ্যমে মসজিদটি নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ইতিমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে নকশাসহ প্রাথমিক কাজ। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ কোটি টাকা। আশা করি সবার আন্তরিক সহযোগিতায় কাজটি সুসম্পন্ন করা যাবে।’ মসজিদের নকশা প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান তারুণ্য ডিজাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম ভুইয়া বলেন, ‘পুরো আঙিনাটির আয়তন ১ লক্ষাধিক বর্গফুট। এ জায়গাকে ভিত্তি করে পরিকল্পনাটি করা হয়েছে। থাকবে ১৩০ ফুট উচ্চতার মিনার, সুপ্রশস্ত প্রবেশদ্বার, ঈদগাহ, কবরস্থান, এতিমখানা, মাদরাসা সংবলিত একাডেমিক ভবন, বৃহৎ পরিসরের মহিলা-পুরুষ ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য পৃথক অজুখানা, এবাদতখানা, রান্নাঘর, ডাইনিং হল ও পার্কিং। নান্দনিকতার ছোঁয়া লাগবে মসজিদ সংলগ্ন পুকুরে।

পুকুরপাড়ে থাকছে সুদৃশ্য পুকুরঘাট, ওয়াকওয়েসহ অনন্য সাধারণ ল্যান্ডস্কেপ। দেশ-বিদেশের পর্যটক বিবেচনায় পুকুরপাড়কে দেওয়া হয়েছে পার্কের আদল। অজুখানা ও পুকুরপাড় মিলে একসঙ্গে অজু করতে পারবেন ১৬০ জন। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে বুড়ো মসজিদটি পুণ্যময় তীর্থস্থান হিসেবে সমাদৃত। জনশ্রুতি আছে, প্রায় তিন শত বছর আগে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা হয়। তবে ঠিক কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সঠিক দিনক্ষণ জানা নেই। মোঘল আমলের শেষের দিকে প্রথমে শনের ছাউনি দিয়ে মসজিদটি গড়া হয়। চট্টগ্রামের তৎকালীন প্রশাসক থানাদার ওয়াসিন চৌধুরী এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর দাদা শেখ নাছির উদ্দিন তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের গৌড় এলাকা থেকে এ এলাকায় ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে আগমন করেছিলেন। শেখ নাছির উদ্দিন এলাকার মুসল্লিদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে মসজিদটি প্রতিষ্ঠার জন্য বলেন। ওয়াসিন চৌধুরীর পিতা একজন ইবাদত-বন্দেগি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইবাদত-বন্দেগিতে এতই মগ্ন থাকতেন যে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার কোনো খবর রাখতেন না। বুড়ো বয়সে মসজিদে নামাজ-জিকির-আজকারে দিন-রাত কাটিয়ে দিতেন। আধ্যাত্মিক সাধনায় তিনি দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতেন। ইবাদতে তিনি এতই মশগুল থাকতেন যাতে তাকে সবাই বুড়া হুজুর নামে ডাকত। ইবাদত করতে করতে তিনি এক দিন এই মসজিদ থেকে গায়েব (অদৃশ্য) হয়ে যান। পরবর্তীতে তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাই তাঁর নামানুসারে এটি ‘বুড়া মসজিদ’ নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করে। জানা যায়, প্রথমে অল্প কজন মুসল্লি নামাজ পড়ার মতো জায়গা নিয়ে পাতার বেড়া এবং ওপরে দুনালি ছন দিয়ে মসজিদের প্রথম ঘর নির্মিত হয়। প্রতি বছর ছাউনি ও বেড়া পরিবর্তন করা হতো। ২০-২৫ বছর পর্যন্ত এভাবেই চলে আসছিল মসজিদের কার্যক্রম। সে সময় সাপ, বাঘ ও জঙ্গলময় ছিল ওই এলাকা। ফলে বাঘের ভয় ও ঝোপ-ঝাড়ের মাঝে অবস্থিত হওয়ায় এ মসজিদে মুসল্লিরা রাতে নামাজ আদায় করতে পারতেন না। নিরাপদ দূরত্বে থেকে মুসল্লিরা আজান দিয়ে চলে যেত। পরে চারপাশে বাঁশের বেড়া এবং ওপরে ছনের ছাউনি দিয়ে ১০-১৫ হাত দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এভাবে ছিল অনেক বছর। ১৮৮৬ সালে ভূমিকম্পের কারণে বেড়া ও ছনের ছাউনি ঘর ভেঙে যায়। ভাঙা অবস্থায়ও জোড়াতালি দিয়ে আরও ২০-২৫ বছর চলে। পরে স্থানীয়রা মাটির দেয়াল তুলে পুনর্নির্মাণ করেন। এভাবে ৪-৫ বার নির্মাণ করা হয়। প্রায় ১০০ বছর পূর্বে মসজিদের কিয়দংশ পাকাকরণ করা হয়। ১৯৪০ সালে মসজিদের পুরনো ভিত্তি ভেঙে নতুন করে ছাদ জমিয়ে পাকাকরণ করা হয়। ইমারতটি এখনো মসজিদের মধ্যখানে বহমান আছে। ১৯৭৪ সালে ৫০০-৬০০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা করে মসজিদ সংস্কার-সম্প্রসারণ করা হয়। ১৯৭৫ সালে মসজিদের পাকা ভবনের গেট নির্মিত হয়। ১৯৮৬ সালের দিকে দ্বিতীয় তলায় উন্নীত করা হয়।

সর্বশেষ খবর