দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষ ও যানবাহনের চাপ। ক্রমবর্ধমান এ চাপ মোকাবিলা করতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বন্দর ঘিরে চালিয়ে যাচ্ছে রিং রোড নির্মাণের কাজ। এর নির্মাণকাজ শেষ হলে চট্টগ্রাম বন্দর ও ইপিজেডমুখী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান এবং লরির মতো ভারী যানবাহন নগরের অভ্যন্তরীণ রুট ব্যবহার করবে না। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত থেকে হালিশহরের দিকে ৫ কিলোমিটার, দক্ষিণ কাট্টলী থেকে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রাম রিং রোড চট্টগ্রাম ইপিজেডের সঙ্গে যুক্ত হবে। নির্মাণাধীন কর্ণফুলী টানেলের সঙ্গেও যুক্ত হবে এটি। ফলে অনেকটাই যানজটমুক্ত হবে চট্টগ্রামের সড়কগুলো। শুধু তাই নয়, নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন চট্টগ্রাম বন্দর, সিইপিজেড, কেইপিজেড ও মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হবে চট্টগ্রামের এ আউটার রিং রোড।
সিডিএ-সূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলী টানেলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, মহেশখালী, কক্সবাজার অর্থনৈতিক জোন থেকে বন্দরে সহজে পণ্য পরিবহন করা যাবে। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক দিয়ে কক্সবাজারমুখী গাড়ি টানেল হয়ে নদীর দক্ষিণ পাড়ে যেতে পারবে। একইভাবে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর থেকে পণ্যপরিবাহী যানবাহনও দ্রুততম সময়ে দক্ষিণ কাট্টলী হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে যাতায়াত করতে পারবে। এতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে গতিশীলতার পাশাপাশি পর্যটকও বাড়বে। একই সঙ্গে শহররক্ষা বাঁধ হিসেবেও কাজ করবে আউটার রিং রোড।
আউটার রিং রোড প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএর ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জানান, দক্ষিণ কাট্টলী রাসমণি ঘাট থেকে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি পর্যন্ত সাগরপাড়ের প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় আউটার রিং রোড ও উপকূলীয় বেড়িবাঁধ মজবুতকরণ প্রকল্পের কাজ চলছে। ৯০ ফুট চওড়া ও সমুদ্রসমতল থেকে ৩০ ফুট উঁচু এ সড়ক নির্মাণের কাজ ইতিমধ্যে ৯০ শতাংশ শেষ করেছে ঠিকাদারি সংস্থা এসইএল-কেএনআরজেবি। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে চট্টগ্রাম আউটার রিং রোডের কাজ।হাসান বিন শামস বলেন, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত থেকে হালিশহরের দিকে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে সাগরে ওঠানামার জন্য জেটি সুবিধা থাকছে। এ ছাড়া ওয়াকওয়ে, বসার জন্য বেঞ্চ, নির্দিষ্ট দোকান, বাচ্চাদের খেলার জন্য পৃথক জোন, গ্রিন জোন ও পার্কিং সুবিধা রাখা হয়েছে। আর সাগরের পানির সরাসরি আঘাত থেকে রক্ষা করতে বেষ্টনী দেয়াল ও সিমেন্টের ব্লক তৈরি করা হবে।
প্রকল্পসূত্রে জানা গেছে, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)-এর সহযোগিতায় ১ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। তবে আউটার রিং রোডের সঙ্গে বিভিন্ন সুবিধা যুক্ত করতে গিয়ে এর বাজেট বাড়িয়ে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য বর্ধিত বাজেটের বাকি অর্থ দেবে বাংলাদেশ সরকার। এদিকে আরও এক দফা ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ছে ‘চিটাগাং সিটি আউটার রিং রোড নির্মাণ’ প্রকল্পের। আগামী জুনে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একনেকের বৈঠকে ‘চিটাগাং সিটি আউটার রিং রোড (তৃতীয় সংশোধন)’ অনুমোদিত হয়েছে। এ পর্যায়ে ব্যয় বাড়ছে ১৬৫ কোটি টাকা। একই সঙ্গে প্রকল্পের সময় ছয় মাস বাড়িয়ে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২ হাজার ৬৭৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার খরচ করছে ২ হাজার ৩২ কোটি ৪০ লাখ ৪২ হাজার আর জাইকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ৬৪৩ কোটি ৫৫ লাখ ৮ হাজার টাকা।
প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মামুন আল-রশীদ বলেন, ‘প্রকল্পটি তৃতীয় সংশোধন বাস্তবায়ন হলে জলোচ্ছ্বাস থেকে চট্টগ্রাম শহরকে রক্ষা, যানজট হ্রাস এবং ইপিজেডের কর্মী ও বিনিয়োগকারীদের সময় এবং কর্মঘণ্টা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।’
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেবিআইসি) চট্টগ্রাম শহরের অপ্রতুল অবকাঠামোগত অসুবিধাগুলো চিহ্নিত করতে ২০০৬ সালে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। সমীক্ষায় শহর রক্ষাকারী বাঁধ ও একই সঙ্গে রাস্তা নির্মাণের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন মাস্টারপ্ল্যানেও শহরের আউটার রিং রোডের উল্লেখ করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ২৯ মার্চ একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। সে সময় প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৮৫৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর। প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি, মৌজা দর বৃদ্ধি এবং স্ট্রাকচারের ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রথম সংশোধন আনা হয়। সেখানে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৪৯৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জুনে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বর প্রথম সংশোধিত প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ হয় ২ হাজার ৪২৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের সময় ধরা হয় ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ পর্যন্ত। এ পর্যায়ে প্রকল্পে যোগ হয় ১০ দশমিক ২০ কিলোমিটার বাঁধের ঢাল বরাবর সিসি ব্লক দ্বারা পিচিং কাজ, নির্মাণাধীন সড়কের মধ্যে সমুদ্রসংলগ্ন অংশে ওয়েভ ডিপলিসিটর ওয়াল নির্মাণ অন্তর্ভুক্তি, সড়কটি দুই থেকে চার লেনে উন্নীতকরণ ও পর্যটনশিল্পের বিকাশের জন্য সমুদ্রতীরে সৌন্দর্যবর্ধন। এদিকে নগর থেকে বিমানবন্দরগামী রোডের ওপর যানবাহনের চাপ কমাতে গত আগস্টে আউটার রিং রোডে আংশিকভাবে যান চলাচলের অনুমতি দেওয়া হলেও চলতি বছরের শেষে এ রোডে পুরোদমে যানবাহন চলা শুরু করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। প্রকল্প পরিচালক কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘প্রকল্পের ৯০ থেকে ৯২ শতাংশ কাজ শেষ। ২০২১ সাল পর্যন্ত কাজের মেয়াদ থাকলেও চলতি বছরের শেষের দিকে পুরোদমে যানবাহন চলতে পারবে বলে আমরা আশাবাদী। এটি চালু হলে বন্দর, শিল্পকারখানা ও বিমানবন্দরগামী যানবাহন এ রোড দিয়ে চলতে পারবে। টানেল থেকে সরাসরি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যাবে। ফলে নগরের অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর ওপর চাপ কমবে। উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বন্যা ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে শহর, বিমানবন্দর, ইপিজেডসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষা হবে। শুধু দেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এ রোড হবে একটি মাইলফলক।’