রাজীব হোসেন রাজু। বাড়ি বগুড়ায়। থাকেন যশোরে। সেখানেই তার ছোটখাটো ব্যবসা। প্রেম করে বিয়ে করেছেন। স্ত্রীকে নিয়ে তার ছোট সংসার। বেশ ভালোই হেসেখেলে দিন কেটে যাচ্ছে তাদের। তবে এই সুখের সংসারে হঠাৎ কালো মেঘ। এক মধ্যরাতে বাসার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙে রাজীবের। খাট থেকে নেমে ঘরের আলো জ্বালিয়ে প্রথমেই তার স্ত্রীর মুখে দৃষ্টি রাখেন। গভীর ঘুমে তার স্ত্রী। বিরক্ত আর ঘুম চোখে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ান রাজীব। কে কড়া নাড়ে এত রাতে? রাজীব জানতে চান। আমরা পুলিশ। দরজা খুলুন। এমন জবাব শুনে চমকে ওঠেন রাজীব। যেন জবান তার বন্ধ হয়ে গেছে। আবারো দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। তারা বলেই যাচ্ছেন, দরজা খুলুন। আমরা পুলিশের লোক। সম্ভিত ফিরে পান রাজীব। ভিতরের রুম থেকে এবার তার স্ত্রীর কণ্ঠ ভেসে আসে। রাজীব, কে এসেছে এত রাতে। দাঁড়াও আমি আসছি। একথা বলেই রাজীবের স্ত্রী দরজার সামনে আসেন। রাজীব তখন ঘামছিলেন। হাত কাঁপছিল তার। তাকে দেখেই তার স্ত্রী অবাক। কী ব্যাপার তুমি ঘামছ কেন রাজীব। কে এসেছে? রাজীব এবার মুখ খোলেন। বলেন, পুলিশ। তোতলাচ্ছিলেন রাজীব। রাজীবের স্ত্রী এবার চিৎকার করে বলেন, আপনারা যেই হোন, সকালে আসুন। এখন এত রাতে কেন এসেছেন। এ কথা শুনে দরজার বাইরে থেকে কেউ বলছিলেন, ম্যাডাম একটু দরজা খুলুন। আমরা একটা তথ্য যাচাই করতে এসেছি। কোনো ভয় নেই। এ কথা শুনে রাজীবের স্ত্রী দরজা খুলতে বলেন। কিন্তু রাজীব দরজা খুলতে চান না। রাজীবের স্ত্রী বলেন, তুমিতো কোনো অপরাধী নয়। তবে কেন এমন করছ? এ কথা বলেই রাজীবের স্ত্রী এক রকম জোর করেই দরজা খুলে দেন। একদল পুলিশ ওই বাসার ভিতর ঢুকে পড়ে। রাজীবকে জাপটে ধরে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক হয়েছে। লুকিয়ে বেশ ছিলি। এবার চল আমাদের সঙ্গে। রাজীব কোনো কথা বলছেন না। তবে অবাক রাজীবের স্ত্রী। তিনি পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, তার স্বামী নিতান্তই ভদ্র মানুষ। কোনো খারাপ কর্মকান্ডে নেই। পুলিশের জবাব, রাজীব একজন খুনের আসামি। নিজ হাতে তিনি খুন করে পালিয়ে আছেন প্রায় আড়াই বছর ধরে। রাজীবের স্ত্রী বিশ্বাস করতে চান না। প্রায় ছয় মাস ধরে সংসার করছেন, কিন্তু কখনো কোনো কিছু বোঝেননি। যে কারণে পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বগুড়া জেলা পুলিশ যশোর থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় রাজীবকে। এ সময় যশোর পুলিশও তাদের সঙ্গে ছিল। পুলিশের মুখোমুখি রাজীব। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বেশি সময় লাগেনি পুলিশকে তার কাছ থেকে সত্য বের করতে। রাজীব বলে দিয়েছেন কীভাবে তার বন্ধু বিপ্লবকে খুন করেছিলেন। ২০১৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার নগরপাড়া মহিশাপাড়া গ্রামে একটি কালভাটের নিচ থেকে অজ্ঞাত যুবকের বস্তাবন্দী ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশের পরিচয় না পেয়ে পুলিশ একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। লাশের ছবি বিভিন্ন পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়। ছবি দেখে বগুড়া সদরের ঠনঠনিয়া পশ্চিমপাড়ার হযরত আলী থানায় গিয়ে লাশটি শনাক্ত করে বলেন, এটি তার ছেলে বিপ্লবের লাশ। পরে মর্গের হিমাগার থেকে তাকে লাশ বুঝে দেওয়া হয়।
এ মামলার তদন্ত ভার প্রথমে দেওয়া হয় সোনাতলা থানা পুলিশের এসআই শরিফুল ইসলামকে। এর মাঝে তার অন্যত্র বদলি হওয়ায় দ্বিতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে এসআই আবদুল মান্নানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কেউই মামলার কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞার নির্দেশে মামলাটির তদন্তভার সোনাতলার থানা পুলিশের পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) জাহিদ হোসেন গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে পেরিয়ে যায় আড়াই বছর।
তদন্তের শুরুতেই বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কিত সবাইকে নজরদারিতে রেখে কাজ শুরু করে তদন্তকারী কর্মকর্তা। এর মধ্যে একটি নাম বিভিন্ন স্থান থেকে রাজীবের নাম জানতে পারে পুলিশ। রাজীব হলো বিপ্লবের বন্ধু। খুনের আগে বিপ্লবের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কথা বলেছেন রাজীব। ট্রেডিশনাল এবং প্রযুক্তিগত তদন্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারে রাজীব হোসেন (২৮) আড়াই বছর ধরে যশোরে পালিয়ে আছেন। সেখানে রাজীব তার মামার বাসায় দুই বছর ধরে অবস্থান করেন। এরপর তিনি প্রেম করে বিয়ে করে বিগত ছয় মাস ধরে যশোরেই একটি ভাড়া বাসায় গোপনে অবস্থান করছেন। তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (শিবগঞ্জ-সোনাতলা সার্কেল) কুদরত ই খুদা শুভর নেতৃত্বে সোনাতলা থানা পুলিশ যশোর থেকে রাজীবকে গ্রেফতার করে। পরে তার দেওয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে খুনের সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেফতার করা হয়। তারা হলো শহরের খান্দার এলাকার রমজান আলীর ছেলে বেলাল হোসেন ও তার ভাই হাসান আলী, একই এলাকার আবদুস সামাদের ছেলে আবদুর রহমান ওরফে শুটকু, সোনাতলা উপজেলার লক্ষ্মী নারায়ণপাড়ার মৃত রামনাত মন্ডলের ছেলে সঞ্জয় কুমার মন্ডল। পুলিশ জানতে পারে, বিপ্লব ও রাজীব প্রত্যেকেই একটি সন্ত্রাসী গ্রুপে ছিলেন।
যারা বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত। হত্যাকান্ডের কয়েক মাস আগে থেকে রাজীবের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিপ্লবের দ্বন্দ্ব চলছিল। এ কারণে রাজীবের সঙ্গে অপর আসামি বেলাল হোসেন ও বিপ্লব দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এর জের ধরে বিপ্লব বেলালকে ছুরিকাঘাত করেন।
এরপরই মূলত রাজীব বিপ্লবকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। রাজীবের পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা যোগ দেন। ঘটনার দিন বিপ্লবকে হত্যার উদ্দেশে রাজীব বগুড়া থেকে একটি ভাড়া করা প্রাইভেটকারে সোনাতলার কর্পূর বাজারের একটি চাতালে নিয়ে যান। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল চাতালের কর্মচারী সঞ্জয়সহ অন্য আসামি রাজীব, বেলাল, হাসান, শুটকুসহ আরও কয়েকজন। সেখানে বিপ্লবকে তারা উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। এরপর বিপ্লবের লাশ বস্তায় ভরে সোনাতলার নগরপাড়া মহিশাপাড়া গ্রামের কালভাটের নিচে ফেলে পালিয়ে যায়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিপ্লবকে খুন করে খুনি পালিয়ে যায় যশোর জেলায়। এরপর দীর্ঘদিন সেখানে গাঢাকা দিয়ে থাকার পর নিজেকে নিরাপদ মনে করে। যশোরেই একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়েও করেন তিনি। খুনি ভেবেই নিয়েছিল তার এ অপকর্ম কখনো প্রকাশ হবে না। কিলিং মিশনে থাকা আরও চারজন একই ভাবনায় দিন পার করছিলেন। কিন্তু পুলিশের নিবিড় তদন্ত কার্যক্রমে ধরা পড়ে যায় এ গুপ্ত ঘাতকের দল।