রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় ২৫ এপ্রিল মোটরসাইকেলে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন ব্যবসায়ী শফিক আহমেদ। লকডাউনের কারণে রাস্তায় তেমন যানজট ছিল না। কিন্তু তার পেছনে থাকা একটি প্রাইভেটকার চালক অকারণে সাইড পাওয়ার জন্য হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে গাড়িচালককে সাইডে গাড়িটি থামানোর জন্য বললেন শফিক এবং জানতে চাইলেন অকারণে কেন তিনি হর্ন বাজাচ্ছিলেন? উত্তরে গাড়িচালকটি বলল, ‘ইচ্ছে হইছে তাই বাজাইছি!’ এ অবস্থা রাজধানীর বেশির ভাগ গাড়িচালকদেরই। প্রয়োজন ছাড়াই তারা আগে যেতে অকারণে ও একনাগাড়ে হর্ন বাজান। আর এর ফলে সৃষ্ট শব্দদূষণ নিয়ে তারা মোটেও চিন্তিত নন। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার মতো মিরপুরের পল্লবী আবাসিক এলাকায় গভীর রাতেও নির্মাণাধীন বিভিন্ন বাড়ির কাজের জন্য এখন অতিষ্ঠ সেখানকার বাসিন্দারা। পল্লবী সাড়ে এগারো মসজিদুল আমানের সামনের নির্মাণাধীন বাড়ির কাজের মাত্রাতিরিক্ত শব্দের জন্য গভীর রাতে ঘুমাতে পারছেন না আশপাশে বাসিন্দারা। সাইফুল সালমান নামের স্থানীয় বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, বাড়ি নির্মাণের কাজের জন্য রাতে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে। অথচ বিধিমালা অনুযায়ী সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি চালানোয় নিষেধাজ্ঞা আছে। এ অবস্থায় আজ বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস পালিত হচ্ছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘প্রটেক্ট ইউর হেয়ারিং, প্রটেক্ট ইউর হেলথ’। রাজধানী ঢাকায় দিনকে দিন শব্দদূষণ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরের জরিপ বলছে, ঢাকায় শব্দের মাত্রা নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে তিন গুণ বেশি। আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যামফোর্ডের আরেক গবেষণা থেকে জানা যায়, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ হচ্ছে। এমনকি সচিবালয়ের মতো নীরব এলাকাতেও তীব্রতর শব্দদূষণ হচ্ছে। শব্দদূষণের প্রভাবে ছাত্র-ছাত্রী, শিশু, হাসপাতালের রোগী, ট্রাফিক পুলিশ, পথচারী ও গাড়ির চালকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। আর চিকিৎসকদের মতে, শব্দদূষণের কারণে একজন ভুক্তভোগীর হাইপারটেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি হ্রাস, স্নায়ুবিক সমস্যা ও মানসিক চাপ তৈরির আশঙ্কা আছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকায় শব্দদূষণের উৎসগুলো হচ্ছে- গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার, শিল্পকারখানা থেকে সৃষ্ট শব্দ। তবে মোটরযানের হর্ন শব্দদূষণের প্রধান কারণ। এ ছাড়া কলকারখানা এবং নির্মাণ কাজ হতেও শব্দদূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে পটকা কিংবা আতশবাজিও শব্দদূষণের জন্য দায়ী। সাধারণত যে এলাকাগুলোতে শব্দদূষণ বেশি হচ্ছে সেখানকার দোকানদার, ব্যবসায়ী, বাসিন্দা, কর্মরত ট্রাফিক পুলিশ ও রিকশাচালকদের কানের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে বেশি যেতে দেখা যচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে শব্দদূষণ সম্পর্কে মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে। বিরক্তিকর উচ্চমাত্রার শব্দ মানসিক ও শারীরিক যে কোনো রকমের ক্ষতি করতে পারে। শব্দদূষণ-সংক্রান্ত আইনের বাস্তবায়ন এবং এ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার বিষয়টি নির্ভর করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর। আবার আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যতই চেষ্টা করুক না কেন, নাগরিকরা এ ব্যাপারে সচেতন না হলে শব্দদূষণ রোধ করা যাবে না। শব্দদূষণ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির জন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে সচেতনতামূলক তথ্য রাখার ওপর তারা জোর দিয়েছেন। পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা সবাই শব্দদূষণের ভিকটিম। আমাদের অনেকে শব্দদূষণ করে বুঝেও না বোঝার অভিনয় করেন। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই পরিবেশ অধিদফতর থেকে একটি প্রকল্প চালু করা হয়। ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে শব্দদূষণ যেসব উৎসের কারণে হয় তাদের সচেতন করা এবং স্কুল, হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকাকে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে সেখানে সংশ্লিষ্ট বিধিনিষেধ কার্যকর ব্যবস্থা করার কথা। এ ছাড়া নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধেও প্রকল্পে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা আছে।’ মহামারীর কারণে বর্তমানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা না গেলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।