রাজধানীর মিরপুর-২ নম্বর সেকশনের এ-বøকের ডুইপ আবাসিক এলাকা। পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক তোজাম্মেলের বাসাও সেখানে। তিনি স্ত্রী নিয়ে থাকেন। এক রাতে বাসায় ঢুকতে গিয়েই তিনি দেখতে পান, দরজায় বড় একটি তালা ঝুলছে। তোজাম্মেলের সঙ্গে ছিলেন তার এক বেয়াই হুমায়ুন কবীর। তোজাম্মেল অবাক। চিন্তার রেখা তার কপালে। ঘামছিলেন। তাকে না বলে কোথাও যায় না তো! আস্তে আস্তে বলছিলেন তিনি তার বেয়াইর কাছে। পকেট থেকে একই তলার অতিরিক্ত চাবি বের করে তালা খুলে তোজাম্মেল ভিতরে ঢোকেন। সঙ্গে বেয়াইও। ভিতরে লন্ডভন্ড অবস্থা। স্ত্রীর খোঁজ করতে এ ঘর থেকে ও ঘর দৌড়াতে থাকেন তোজাম্মেল। টয়লেটে যান। তোজাম্মেলের চিৎকার। খুন! খুন! অন্য ঘর থেকে তার বেয়াই হুমায়ুন কবীর ছুটে যান তোজাম্মেলের কাছে। টয়লেটে পড়ে আছে তোজাম্মেলের স্ত্রীর মৃতদেহ। রক্তাক্ত। দুই চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। হাত-পায়ের রগ কাটা। চেহারা ঝলসানো। তাকানো যাচ্ছে না। হাউমাউ করে কাঁদছেন তোজাম্মেল। পুলিশ আসে। হয় তদন্ত। কিন্তু পুলিশ এ খুনের ঘটনাটি নিয়ে নিজেরাই দ্ধন্ধে পড়ে যায়। খুনি কে? এ প্রশ্নের জবাব তারা খুঁজে পাচ্ছিল না। হঠাৎ একটি মোবাইল ফোনের সূত্র পায় পুলিশ। সেই সূত্রেই খুনির নাগাল। কিন্তু খুনির পরিচয়ে পুলিশ হতবাক।
যে ব্যক্তি খুনিকে ধরতে পুলিশের সঙ্গেই ছিল সময়ে-অসময়ে, কাঁদতে কাঁদতে ছিলেন অস্থির-সেই কি না খুনি! এটা কীভাবে সম্ভব! এমন ভাবনায় পড়ে পুলিশ। কারণ খুনি আর কেউ নন, তিনি হলেন চিকিৎসক স্বামী তোজাম্মেল হোসেন। পরকীয়ায় মত্ত এই চিকিৎসক নিজ স্ত্রীকে নৃশংসভাবে হত্যা করতে পিছপা হননি। শুধু তাই নয়, সাতসকালে স্ত্রীকে খুন করেই তোজাম্মেল হাসপাতালে যান। ডিউটি করেন সারা দিন। রোগী দেখেন। দেখাও করেন তার প্রেমিকার সঙ্গে। রাত ১টায় বাসায় ফিরে নাটক করেন। শক্ত নার্ভের এই চিকিৎসকের ব্যবহার পুলিশের কাছে নজিরবিহীন। পুলিশ গ্রেফতার করে এই চিকিৎসককে। খুনের দায় স্বীকার করে নেন তোজাম্মেল হোসেন। বেরিয়ে আসে একটি নষ্ট জীবনের নোংরা কাহিনি। গ্রেফতার হয় তার প্রেমিকা নার্গিস। ঘটনাটি ২০০৮ সালের। নারায়ণগঞ্জের পাগলার নন্দলালপুরের আবদুল হামিদের মেয়ে ফাহমিদা আক্তার নাজমা। ১৯৯৬ সালে বিয়ে হয় ডা. তোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হতেন নাজমা। নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ২০০০ সালে তিনি মিরপুর থানায় একটি জিডিও করেছিলেন। কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে পারেননি। নৃশংস খুনের শিকার হন স্বামী ও স্বামীর প্রেমিকার হাতে। ২০০৮ সালের ৬ জুলাই বাসায় নাজমার মৃতদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ লাশের সুরতহাল করে। ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। মিরপুর থানা পুলিশ জেরা করতে থানায় নিয়ে যায় তোজাম্মেলকে। বিসিএস পাস করা চিকিৎসক তোজাম্মেলের কান্নায় পুলিশ নিজেই বিব্রত। তারা তোজাম্মেলকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। মৃত্যুর সংবাদ শুনে নাজমার ভাই ছুটে আসেন থানায়। এসেই তোজাম্মেলকে বলেন, ‘তুই আমার বোনকে মেরে ফেললি?’ এমন প্রশ্নে পুলিশ প্রথমবারের মতো তোজাম্মেলের দিকে সন্দেহের দৃষ্টি দেয়। কিন্তু এর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। পুলিশের জেরার মুখে, তোজাম্মেল জানিয়েছিলেন, সন্ধ্যায় তার স্ত্রীকে ফোন দিলেও কোনো রিপ্লাই পাননি। পরে ফোন বন্ধ পান। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আর ফোন দেননি। সেদিন বেশি রাতে বাসায় ফিরে স্ত্রীর লাশ দেখতে পান। নাজমার সেই মোবাইল ফোন কোথায়? পুলিশ প্রশ্ন রাখে তোজাম্মেলের কাছে। কিন্তু সেটি পাওয়া যায়নি বলে জানান তোজাম্মেল। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। তদন্ত কর্মকর্তা কোন সূত্র ধরে এগোবেন তা নিয়ে ভাবছেন। হঠাৎ তার মাথায় এলো নাজমার মোবাইল ফোনের কথা। দুই দিন পর ওই নম্বরে ফোন দেয় পুলিশ। ফোন খোলা। মিরপুরেই একটি দোকানে গিয়ে ওই নম্বরের সন্ধান পাওয়া যায়। পুলিশ ওই দোকানদারকে ফোনের কথা জিজ্ঞেস করে। সে পুলিশকে জানায়, এক মহিলা সিম বিক্রি করে গেছেন। কিন্তু মোবাইল ফোন নিয়ে গেছেন। দোকানদারকে নিয়ে পুলিশ যায় কাফরুলে ওই মহিলার বাসায়। মহিলার কাছ থেকে উদ্ধার হয় সেই মোবাইল ফোনটি। এই মোবাইল ফোন মামলার তদন্তে নাটকীয় মোড় নেয়। আঁধারে ঢেকে থাকা তদন্ত পায় আলোর সন্ধান। পুলিশ আরও এগিয়ে যায় সেই সূত্র ধরে। পুলিশ এই মহিলার কাছ থেকেই সব তথ্য পায়। জেরার মুখে তিনি ফাঁস করেন খুনের আদ্যোপান্ত। কীভাবে নাজমা খুন হলেন, কেন খুন হলেন- সব তথ্য বেরিয়ে আসে তার কাছ থেকে। এই মহিলাই হলেন তোজাম্মেলের প্রেমিকা সামসুন নাহার নার্গিস বেগম। যার প্রেমে মত্ত হয়েছিলেন ডাক্তার তোজাম্মেল। নার্গিস পুলিশকে জানান, তার স্বামী হুমায়ুন কবীর হচ্ছেন ডাক্তার তোজাম্মেলের বেয়াই। ঘরে বউ রেখে ডা. তোজাম্মেল আরও একজন মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতেন। তার নাম লাকি। কিন্তু ডা. তোজাম্মেলের অনুপস্থিতিতে তার স্বামী হুমায়ুন কবীর লাকির সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পরে তারা গোপনে বিয়েও করেন। নার্গিস জানান, তার স্বামী হুমায়ুন কবীর গোপনে বিয়ে করার পর তার দেখভাল করতেন না। এ কারণে তিনি যোগাযোগ করেন ডা. তোজাম্মেলের সঙ্গে। ডা. তোজাম্মেলের চেম্বারে গিয়ে তিনি জানিয়ে দেন, তার প্রেমিকা লাকিকে বিয়ে করেছেন হুমায়ুন কবীর। তার খরচপাতিও পাঠান না। ডা. তোজাম্মেল নার্গিসকে জানান, খরচপাতি তিনি নিজেই চালাবেন। তার আয়-ইনকাম অনেক। এ নিয়ে চেম্বারেই তাদের অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আস্তে আস্তে তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হয়। ডা. তোজাম্মেল তার স্ত্রী নাজমার খোঁজখবর খুব একটা রাখেন না। বাসায় একা নিঃসঙ্গ সময় কাটান নার্গিস। এরপরও তিনি স্বামীর অপেক্ষায় বসে থাকতেন একসঙ্গে খাবার খাবেন বলে। কিন্তু ছোটখাটো বিষয় নিয়ে প্রায় প্রতিদিন তাদের ঝগড়া-ফ্যাসাদ লেগে থাকত। মারধরও করতেন নাজমাকে। নার্গিস প্রতিনিয়ত চেম্বারে গিয়ে তোজাম্মেলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসতেন। ২০০৮ সালের ৫ জুলাই তোজাম্মেলকে ফোন দেন ৫ হাজার টাকার জন্য। তোজাম্মেল বলেন, ‘কাল আমার বাসায় চলে আসো। সেখানেই টাকাটা দেব। নাজমা থাকলেও অসুবিধা নেই। বলে দেব আমার পেশেন্ট’। পরদিন সকালেই নার্গিস যান তোজাম্মেলের বাসায়। নাজমা তাকে আপ্যায়ন করেন। নাস্তা দেন। তারা তিনজন নাস্তা খান। নাজমা হাসিখুশি। এক পর্যায়ে নাজমা চা নিয়ে আসতে রান্নাঘরে যান। ড্রইংরুমে এসেই দেখেন তার স্বামী আর নার্গিস অন্তরঙ্গ অবস্থায় রয়েছেন। এ দৃশ্য দেখে চিৎকার করে গালাগাল করতে থাকেন নার্গিসকে। রেগে ফেটে যান তোজাম্মেল। নাজমার গলা চেপে ধরেন। নার্গিসকে বলেন রান্নাঘর থেকে দা নিয়ে আসতে। নার্গিস দা নিয়ে আসেন। সেই দা দিয়ে নাজমাকে কোপাতে থাকেন। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। মৃতদেহের ওপর গরম পানি ঢেলে দেন তোজাম্মেল। চোখ উপড়ে ফেলেন। ডা. তোজাম্মেল নাজমার মোবাইল ফোনটি নার্গিসের হাতে দিয়ে বলেন, ‘এটা রাখো। কোনো প্রমাণ রাখা যাবে না।’ খুনের ঘটনার এই শেষটাই হয়ে ওঠে খুনের রহস্য উন্মোচনের শুরু।