বৃহস্পতিবার, ৬ মে, ২০২১ ০০:০০ টা
হেফাজতের শাপলা চত্বর তাণ্ডবের তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে হবে চার্জশিট : ডিবি

আট বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি অর্ধশতাধিক মামলা

নারায়ণগঞ্জে বিচারের মুখোমুখি নেতারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর মতিঝিলে শাপলা চত্বরে হেফাজতের তান্ডবের ঘটনায় দায়ের হওয়া প্রায় অর্ধশতাধিক মামলা আট বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি। এসব মামলায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তের অভাবে ঝুলে আছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) দাখিল। ফলে বেশিরভাগ মামলার বিচার কাজ এখনো শুরু হয়নি। তবে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেছেন, ‘শাপলা চত্বরে হেফাজতের তান্ডবের ঘটনায় দায়ের করা সব মামলা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই নিষ্পত্তি করা হবে। পাশাপাশি আবারও যদি এ ধরনের ঘটনার চেষ্টা করা হয় তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ গতকাল দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে কিছুটা সময় লাগলেও জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আবার নিরপরাধ কাউকেও আইনের আওতায় আনা হবে না।’ ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলে শাপলা চত্বরে হেফাজতের চালানো তান্ডবের ঘটনায় দায়ের হওয়া অর্ধশতাধিক মামলার তদন্ত শেষ হচ্ছে না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনো নিরপরাধ মানুষকে যাতে আইনের আওতায় আসতে না হয় সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে কিছুটা সময় লাগছে। তবে ঘটনার দিনের ভিডিও ফুটেজ ও গ্রেফতারকৃতদের দেওয়া জবানবন্দির ভিত্তিতে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।’ শাপলা চত্বরের মতো ঘটনার পরিকল্পনা বা সক্ষমতা হেফাজতের রয়েছে কি না- জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশের কাজ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে যা যা করা দরকার তা আমরা করব। মামলার সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা চাই না ফের শাপলা চত্বরের মতো ঘটনা ঘটুক। তবে কেউ যদি তান্ডব চালায়, জনগণের সম্পদ বিনষ্ট করে, পুলিশ বা সরকারি কর্মকর্তার ওপর হামলা করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

শাপলা চত্বরের ঘটনায় জামায়াত-বিএনপির অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের কোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘তদন্তে যারই নাম আসবে তাকেই গ্রেফতার করা হবে।’ ২০১৩ সালের তান্ডব-সংশ্লিষ্ট মামলা থেকে অব্যাহতি ও গ্রেফতার বন্ধ রাখতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে হেফাজত নেতাদের সম্প্রতি বৈঠকের বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘হেফাজত নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কী বলেছেন তা আমরা জানি না। তবে যারা জড়িত ছিলেন বা সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে শুধু তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশনা রয়েছে।’ অতিরিক্ত কমিশনার আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে বায়তুল মোকাররমে ব্যাপক নাশকতা হয়। সেটাকে পুঁজি করে গুজব ছড়িয়ে চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সিলেটসহ বেশ কটি জেলায় ব্যাপক তান্ডব চালানো হয়। ভিডিও ফুটেজ দেখে তান্ডবে যারা জড়িত ছিল তাদের শনাক্ত করা হচ্ছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, যুক্তিতর্ক চলছে। সারা দেশে কীভাবে জায়গায় জায়গায় আগুন দেওয়াসহ তান্ডব চলেছে তা সবাই দেখেছে। যারা যারা নাশকতায় জড়িত ছিল, উসকানি দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হবে। এসব ঘটনাতেও যাতে কোনো নিরপরাধী যেন শাস্তি না পায় সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। কেউ যদি নিরপরাধ হয় তা যেন আমাদের জানানো হয়। সে ব্যাপারে আমরা তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে উদ্যোগ নেব।’

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলে শাপলা চত্বর তান্ডবের ঘটনায় শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচির নামে ব্যাপক নাশকতা চালায় হেফাজত নেতা-কর্মীরা। পরদিন ৬ মে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। ২০১৩ সালের নাশকতায় শুধু ঢাকায়ই মামলা হয়েছে ৫৩টি। এর মধ্যে মাত্র ৪টির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪৯ মামলার মধ্যে ৩৪টি থানা পুলিশ ও ১৫টি মামলার তদন্ত করছে ডিবি।

এদিকে নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকাতে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ ও রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিবর্ষণের পর দিন ৬ মে উত্তপ্ত ছিল রাজধানীতে প্রবেশপথ নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়ের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। ওইদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের শিমরাইলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে হেফাজতে ইসলাম, স্থানীয় লোকজন ও হেফাজতের লেবাসে থাকা জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে টানা সাড়ে ৫ ঘণ্টার ব্যাপক সংঘর্ষে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর একজন সদস্য ও পুলিশের দুজন সদস্য ছিলেন। পরে আরও একজন বিজিবি সদস্যের মৃত্যু ঘটে। ওইসব ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁয়ে ১৭টি মামলা হয়েছিল। ১৭টি মামলার মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জে ১১টি ও সোনারগাঁও থানায় ছয়টি মামলা হয়। সব মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। ওইসব মামলায় বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন হেফাজত ও বিএনপি নেতারা।

১৭ মামলাতে জেলা বিএনপির আহ্‌বায়ক অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার, সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান মনির, সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন, মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল, মহানগর যুবদলের সাবেক আহ্‌বায়ক কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ, মহানগর ছাত্রদলের সাবেক আহ্‌বায়ক মনিরুল ইসলাম সজল, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্‌বায়ক আবদুল হাই রাজু, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অধ্যাপক মামুন মাহমুদ, সোনারগাঁ থানা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু জাফর, সাধারণ সম্পাদক আজাহারুল ইসলাম মান্নান, সোনারগাঁও থানা যুবদলের নেতা শহিদুর রহমান স্বপন, বিএনপি নেতা শাহজাহান মেম্বার, বজলুর রহমান, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা সালাউদ্দীন সালু, ছাত্রদল নেতা ওমর ফারুক টিটু, ওসমান গনি রিতুসহ বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের শতাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এ ছাড়া জেলা হেফাজতে ইসলামের আমির মাওলানা আবদুল আউয়াল, মাওলানা আবদুল কাদির, মুফতি মাওলানা আজিজুল হক, মাওলানা আবদুর রহমান, মাওলানা ইব্রাহীম, মাওলানা আবু সায়েম খান, মাওলানা আবদুল কাইয়ুম, মাওলানা মফিজুর রহমান, সমন্বয়ক মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানসহ হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের অসংখ্য নেতা-কর্মীকেও মামলায় আসামি করা হয়। তবে পরবর্তীতে বেশিরভাগ মামলার চার্জশিট থেকেই হেফাজতের শীর্ষ কয়েকজন নেতার নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল।

সর্বশেষ খবর