কয়েক ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে অটোরিকশা স্ট্যান্ডে হাজির হতেন বাবুল মিয়া। এরপর পছন্দসই একটি অটো রিজার্ভ করে যেতেন নির্জন এলাকায়। যেতে যেতে চলত অটো চালকের সঙ্গে নানা রকম খোশগল্প। তার আধাপাকা চুল, বেশভূষা আর বয়সের ভারে অসহায় আচরণ সহজেই মন গলিয়ে ফেলত চালকদের। কাক্সিক্ষত গন্তব্যে যাওয়ার পর রাস্তা থেকে অল্প একটু দূরে তার বাড়ি দেখিয়ে বলতেন, আমার তো এতগুলো ব্যাগ নেওয়ার শক্তি নেই। বয়স তো কম হয়নি। যদি ব্যাগগুলো নিতে একটু সহযোগিতা করতে, বড্ড উপকার হতো। তার এই বিনয় কন্ঠের আবেদনে না করতে পারতেন না অটো চালকরা। অটোরিকশা রেখে ব্যাগ পৌঁছে দিয়ে এসে দেখতেন তার আয়ের একমাত্র অবলম্বনটি আর নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মিলতো না অটোর খোঁজ। এভাবেই বাবুল ও তার চক্রের সদস্যরা অটো নিয়ে চম্পট দেয়। অল্প কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে গ্যারেজে নিয়ে পরিবর্তন করে ফেলা হতো অটোরিকশার রং। আলাদা জায়গায় বিক্রি করে দেওয়া হতো ব্যাটারি। অটো চালকদের সঙ্গে নিখুঁত অভিনয় করায় সন্দেহের বাইরে থাকতেন চক্রের মূল হোতা বাবুল। তার এই অভিনয়ের ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হয়েছে শত শত অটোরিকশা চালক। শুধু অভিনয় নয়, রাজধানীর চারপাশে বাবুলের গড়ে তোলা ১৫ সদস্যের চক্রটি চালকদের অজ্ঞান করেও হাতিয়ে নিয়েছে অসংখ্য অটোরিকশা। গত বুধবার রাজধানী ঢাকার দক্ষিণখান ও নবাবগঞ্জ এলাকা থেকে বাবুল মিয়াসহ এ চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। অন্য গ্রেফতাররা হলেন- জাহিদুল হাসান শিশির, শেখ সোহাগ হোসেন মিন্টু, তৈয়বুর রহমান আকন্দ, অনিক, জামাল হোসেন, জসিম খান ওরফে টোকাই জসিম, শেখ মিলন ও জাহাঙ্গীর আলম। এ সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি অটোরিকশা, বেশ কয়েকটি ব্যাটারি ও মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে দক্ষিণখান থানায় মামলা করা হয়। গতকাল ওই মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হলে আদালত ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, চক্রের মূল হোতা বাবুল মিয়া ১৩ বছর ধরে চুরি পেশায় রয়েছেন। দক্ষিণখান ও কামরাঙ্গীরচর এবং রাজধানীর উপকন্ঠ নবাবগঞ্জ ঘিরে গড়ে তুলেছেন ১৫ সদস্যের চোর চক্র। বয়সে ভাটা পড়ায় অভিনয় করে অটো চালকদের নির্জন এলাকায় নেওয়ার কাজ করতেন তিনি। ২-৩ হাজার টাকা খরচ করে বাজার থেকে ৩-৪টি ব্যাগভর্তি করে বাজার করতেন বাবুল। এরপর অটো স্ট্যান্ডে গিয়ে পছন্দমতো একটি রিজার্ভ করতেন। আগেই ঠিক করে রাখা নির্জন এলাকায় যাওয়ার পর সহযোগিতার নামে তার অভিনয়ের ফাঁদে পা দিয়ে অটোরিকশা হারাতেন চালকরা। নকল চাবির মাধ্যমে অটোরিকশা চুরি করে নেওয়ার কাজ করতো গ্রেপ্তার শিশির, তৈয়বুর ও মিন্টু। অটোরিকশার রং পরিবর্তন ও ব্যাটারি কেনার কাজ করতো জামাল। অটোরিকশা গ্যারেজে নেওয়ার পর মিলন ও জাহাঙ্গীর সব ধরনের সহযোগিতা করতো। টোকাই জসিম কখনো চুরি আবার কখনো অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে ফেলার কাজ করতো। এ চক্রের সদস্যরা চুরির পাশাপাশি একটি প্রাইভেটকারের মাধ্যমে মানুষকে যাত্রী হিসাবে উঠিয়ে চেতনানাশক খাইয়ে সর্বস্ব লুটে নিতো। এছাড়া অভিনব কায়দায় জাল টাকার কারবার, ব্যাংক ড্রাফট জালিয়াতিসহ বিভিন্ন কাজে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বাবুল মিয়ার বিরুদ্ধে ৮টি চুরির মামলা ছাড়াও এ চক্রের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে চুরি, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ একাধিক মামলা রয়েছে। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর এ চক্রের সদস্যদের মধ্যে সখ্যতা হয়েছিল।
অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া ডিবির সাইবার ও স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) আশরাফউল্লাহ বলেন, ডিএমপি এলাকায় সন্ত্রাসী ও অজ্ঞানপার্টির সদস্য গ্রেফতার ও মাদকদ্রব্য উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করার সময় চক্রটির সন্ধান পাওয়া যায়। এরা মূলত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চুরির সংঘবদ্ধ সদস্য।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে অভিনব কায়দায় কয়েকশ’ অটোরিকশা চুরিসহ হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে দক্ষিণখান থানায় মামলা করা হয়েছে। পাশাপাশি এ চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেফতার ও আরো চোরাই অটোরিকশা উদ্ধারে অভিযান চলছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসবাদে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে জানান ডিবির এ কর্মকর্তা।