বৃহস্পতিবার, ২০ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনি ছিল পারিবারিক বন্ধু

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনি ছিল পারিবারিক বন্ধু

রাজধানীর কাফরুলের একটি সড়ক থেকে নিখোঁজ হয় মিশু। দিনের বেলায় ১টি মাইক্রোবাসে কে বা কারা তাকে তুলে নিয়ে যায়। রাজধানীতে একজন সরকারি কর্মকর্তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তান নিখোঁজ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পুলিশ প্রশাসনে শুরু হয় তোলপাড়। যে কোনো মূল্যে মিশুকে উদ্ধারের জন্য পুলিশের ওপর চাপ আসে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। সময় গড়িয়ে যায়। মিশুর সন্ধান পায় না পুলিশ। জলজ্যান্ত সন্তান হঠাৎ হাওয়া হয়ে যাওয়ায় বাবা-মা পাগলপ্রায়। বাবা পুলিশের বিভিন্ন বিভাগে ছোটাছুটি করছেন ছেলের সন্ধানে। নিখোঁজের ঠিক ৪৮ ঘণ্টা পর খবর পাওয়া যায় মিশুর। অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির ফোন আসে বাবার মোবাইলে। ‘হ্যালো, মি. সরকারি কর্মকর্তা। আপনার প্রাণপ্রিয় ছেলে মিশু কিন্তু এখন আমাদের কব্জায়। ছেলেকে পেতে হলে মাত্র ৬০ লাখ টাকার প্রয়োজন। কন্ডিশন একটাই। এক হাতে টাকা, আরেক হাতে ছেলে।  আর কোনো গল্প নেই। থাকলে সব শেষ। জীবিত দূরের কথা, লাশও মিলবে না ভাগ্যে।’ এমন কথা শুনে কোনো জবাব দিতে পারেননি বাবা। ওপাশ থেকে ফোনের লাইন কেটে যায়। ওই নম্বরে বার বার চেষ্টা করেও আর খোলা পায় না বাবা। ঘটনাটি ২০০৬ সালের মে মাসের। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হয়ে দেশের জন্য কত কাজই না করেছেন তিনি, আজ ছেলের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। এমন কথা বলছেন, আর কাঁদছেন। তিনি হতাশ। তার ব্যাংক ব্যালান্স ৬০ লাখ টাকা কেন, কাছাকাছি কোনো অঙ্কও তার জমানো নেই। তিনি এত টাকা কোথায় পাবেন? কে দেবেন- এমন চিন্তা তার মাথায় এখন নতুন করে। মিশুর মা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর্তনাদ করছেন আর বলছেন, ’আমি বুঝি না, জানি না, আমার ছেলেকে এনে দাও’। বাসা থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে যান মিশুর বাবা। পুলিশের সঙ্গে দেখা করেন। মুক্তিপণের বিষয়টি জানান। কিন্তু পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দারা কিছুই করতে পারছে না। মিশুর সিনিয়র বন্ধু হুমায়ুন কবির রয়েছেন মিশুর বাবার সঙ্গে সঙ্গেই। যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই আছেন তিনি। সহযোগিতা করছেন ভীষণ। মিশুর বাবা তার ওপর খুশি। বিপদের সময়ে হুমায়ুন কবিরকে তিনি পাশে পেয়েছেন। এমন দুর্দিনে কে কার সঙ্গে থাকেন! মিশুর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে হুমায়ুন কবির, যিনি কাফরুলের রোড মাস্টার গার্মেন্টের জেনারেল ম্যানেজার। তার বয়স চল্লিশ হলেও মিশুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল তাদের। হুমায়ুন কবিরও বিভিন্ন স্থানে খোঁজখবর নিচ্ছেন। প্রতিদিন একসঙ্গে আড্ডা দিতেন হুমায়ুন কবির। তিনি মিশুদের পারিবারিক বন্ধু হয়ে গেছেন। আত্মীয়র চেয়েও বেশি। যে কারণে ঘটনা শুনে তিনিও আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন। দিন যায়, সপ্তাহ পেরোয়-সন্ধান নেই মিশুর। বাবা-মা আর কারও কাছে ধরনা দেন না। বাসার ভিতর বসে থাকেন। মাঝে-মধ্যে ফোনে যোগাযোগ করেন পুলিশ গোয়েন্দাদের সঙ্গে। এ কয়েক সপ্তাহে মিশুর বাবার বয়স যেন বেড়ে গেছে। চুল সাদা হয়ে গেছে। নির্ঘুম রাত কাটানোর স্পষ্ট ছাপ চেহারায়। সারা দিন শুয়ে বসে কাটান। অফিসেও যান না। ছুটি নিয়েছেন। সেদিন বাসায় শুয়ে আছেন। ছেলেকে নিয়েই চিন্তা তার। কয়েক দিন মুক্তিপণের জন্য ফোন এলেও এখন তা আর আসছে না। বেশ কিছুদিন পর আবারও ফোন আসে টাকার জন্য। কিন্তু কোথায় টাকা নিয়ে আসতে হবে, তা বলত না। ফোনের লাইন কেটে দিত। মিশুর বাবা এ নিয়ে হুমায়ুনের সঙ্গে কথা বলেন। হুমায়ুন বলেন, ‘আপনি ছেলেকে হারাবেন নাকি? টাকা চাচ্ছে, ম্যানেজ করে দিয়ে দিলেই পারেন। আপনার কি আর টাকার অভাব আছে!’ এ কথা শুনে মিশুর বাবা তাকিয়ে থাকে হুমায়ুনের চেহারার দিকে। হুমায়ুন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। পারিবারিক বন্ধু হুমায়ুন কবিরের গতিবিধি নিয়ে হঠাৎ চিন্তিত হয়ে পড়েন মিশুর বাবা। তার কাছে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে তাকে নিয়ে। কিন্তু তিনি কাউকে বিষয়টি বলছেন না। অপহরণকারীদের ফোন যখন আসত তখন হুমায়ুন কবিরকে কাছে পাওয়া যেত না। মুক্তিপণের টাকা দিয়ে দেওয়ার জন্যও হুমায়ুন কবির মাঝে-মধ্যে পরামর্শ দিতেন। এসব নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধছিল তার মনে। এক দিন কাফরুল থানায় গিয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও পর্যবেক্ষণের জন্য পরামর্শ দেন তাকে। এভাবেই ছোটাছুটি করতে করতে কেটে যায় প্রায় দেড় মাস। হুমায়ুন কবিরের কিছু কর্মকান্ডে পুলিশও অনেকটা নিশ্চিত, হুমায়ুন কবির এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। মিশুর বাবা কাফরুল থানায় একটি মামলা করেন। হুমায়ুনকে গ্রেফতার না করে নানা কৌশল নেয় পুলিশ। নানাভাবে হুমায়ুন কবিরকে চাপ দেয়। কৌশলে এড়িয়ে যান হুমায়ুন কবির। একপর্যায়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জেরা করে। খুনের দায় কবুল করেন হুমায়ুন কবির। বলেন, মুক্তিপণের টাকার জন্য মিশুকে তার পরামর্শেই অপহরণ করা হয়। মিশু কোথায়? পুলিশের এমন প্রশ্নে, হুমায়ুন জানান, ও আর নেই। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তার দেওয়া তথ্যে পাবনার শাহজাদপুর এলাকায় গিয়ে অপহরণে জড়িত আরও চারজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বেরিয়ে আসে সব ঘটনা। ২০০৬ সালের ১৩ জুলাই শাহজাদপুরের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের হলুদ খেতের মাটি খুঁড়ে মিশুর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, হুমায়ুন কবির বন্ধুত্ব করেন মিশুর সঙ্গে। কৌশলে মিশুর পরিবারের সঙ্গে মিশে যান। হুমায়ুন কবিরের ধারণা ছিল মিশুর বাবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ায় তার অনেক টাকা আছে। যে কারণে মিশুকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করেন। কিন্তু তিনি মিশুর বাবার সঙ্গে থেকে বুঝতে পারেন, টাকা দিতে পারছেন না। যে কারণে ১৫ দিন পর তার সহযোগীদের তিনি জানান, মিশুকে মেরে ফেলতে হবে। কারণ ছেড়ে দিলে তাদের নাম ফাঁস হয়ে যাবে। মিশুর বাবা তাদের ছাড়বেন না। দীর্ঘ ১১ বছর পর ২০১৭ সালে মহিউদ্দিন মিশু হত্যা মামলায় পাঁচজনের ফাঁসি ও তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় দিয়েছে আদালত। ২০১৭ সালের ২৯ মে ঢাকার ১ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আতাউর রহমান এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন হুমায়ুন কবির, আবুল কালাম, তরিকুল ইসলাম, ইসহাক ও কালাম ওরফে নম কালাম। যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন হাসেম, রাজা ও বাদশা। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভালোভাবে না জেনেই বন্ধুত্ব গড়ে ছিল মিশু। এক পর্যায়ে হয়ে ওঠে পারিবারিক বন্ধু। সময়ে পারিবারিক বন্ধুই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, মিশু হত্যাকান্ড তারই প্রমাণ। একটু সতর্কতাই হয়তো এমন ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখতে হতো না মিশুর বাবা-মাকে। অপরদিকে টাকার লোভে একটি জলজ্যান্ত মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে হুমায়ুন কবির। এতে করে মিশুর পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে তার নিজের জীবনেরও। তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে। অন্যথায় সারা জীবন কাটাতে হবে চার দেয়ালের মাঝেই।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর