শুক্রবার, ২৫ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

হতাশায় বাড়ছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা

জরুরি কল সেন্টার চালু ও দেশব্যাপী কাউন্সেলিং সেবা দেওয়ার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের

জিন্নাতুন নূর

হতাশায় বাড়ছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা

করোনার সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্লাস না থাকা এবং বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় ঘরবন্দী শিক্ষার্থীদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে ‘বিষণœতা, উদ্বিগ্নতা’। যা তাদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছে। অভিভাবকরা, শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব না দেওয়ায় আসছে সময়ে এটি আরও প্রকট হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। অবস্থার ভয়াবহতা অনুবাধন করে তারা দ্রুত জরুরি ভিত্তিতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা পেতে কল সেন্টার চালু করার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে সরকারিভাবে দেশব্যাপী পর্যাপ্ত মানসিক কাউন্সেলিং সেবা দেওয়ার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির তথ্যে, করোনা সংক্রমণের দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে মোট ১৪ হাজার ৪৩৬ জন আত্মহত্যা করেন। আর ৩২২টি আত্মহত্যার কেস স্টাডি করে দেখা যায় যে, যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের ৪৯ শতাংশেরই বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। আর এদের ৫৭ শতাংশই নারী। অপর আরেক জরিপ থেকে জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর গত ১৫ মাসে অন্তত ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী ও ২৯ জন মাদরাসার শিক্ষার্থী। এদের বেশির ভাগের বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে গত ৪ জুন পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত আত্মহত্যা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া যায়। মনোচিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পরিবারের শাসন, কোনো কিছু বায়না ধরে না পাওয়া, প্রেমঘটিত টানাপোড়েন, আর্থিক সংকট, বিষণœতা ও একাকিত্বসহ ছোট ছোট সমস্যায়ও অনেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে তারা তুচ্ছ ঘটনায়ও আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করছে না। আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আঁচল ফাউন্ডেশন থেকে শিক্ষার্থীদের বিষণœতা কাটাতে আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। তাদের জন্য বিনোদনমূলক কর্মকান্ড ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছি। আমাদের ১০ থেকে ১২ জন কর্মী কাউন্সিলিং সেবা দিয়ে থাকে। এদের এক-একজনের কাছে পাঁচ থেকে সাতজন করে কাউন্সিলিং নিচ্ছে। করোনার আগে আমাদের কাছে যে পরিমাণ মানসিক রোগী চিকিৎসার জন্য আসত বর্তমানে তার চেয়ে ছয় থেকে সাত গুণ রোগী বেশি আসছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে। বন্ধুদের সঙ্গে অনেক দিন দেখা না হওয়ায় তারা একাকিত্বে ভুগছে। ঘরে থেকে অধিকাংশ সময়ই তারা মোবাইলে গেম বা অনলাইনে থেকে এবং ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে। আর গঠনমূলক কাজ না করায় তাদের ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকে ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে হতাশা ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। যা তাদের আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অবসাদ কমাতে অনেকে মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত হচ্ছে। অনলাইন আসক্তির কারণে অনেকেরই অনিয়মিত এবং অপর্যাপ্ত ঘুম হচ্ছে। মানসিক চাপের জন্য শিক্ষার্থীরা অবসাদ, প্যানিক অ্যাটাক, অতিরিক্ত রাগ, জেদ, একাকিত্ববোধে ভুগছে। সময় কাটাতে শিক্ষার্থীরা টিকটক অ্যাপসে নেতিবাচক ভিডিও বানাচ্ছে। ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, একজন শিক্ষার্থী যখন বিষণœ বা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে তখন তা স্বীকার করে তার অভিভাবকদের কাছে বিষয়টি খুলে বলতে হবে। আবার বাংলাদেশের অভিভাবকরা তাদের সন্তানের মানসিক সমস্যা হলেও সে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন না এতে অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে। সম্ভব হলে শিক্ষকরা যদি শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেন কিংবা আলাদাভাবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ফোন দিয়ে তার খোঁজখবর নেয় তাহলেও শিক্ষার্থীদের সমস্যা কিছুটা কমবে। সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা পেতে কল সেন্টার চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া সরকারিভাবে সারা দেশে মানসিক কাউন্সিলিং সুবিধা দেওয়ার জন্য জনবল নিয়োগ করা যেতে পারে। তারা ভার্চুয়ালি বা সরাসরি সেবা দিতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক মাহফুজা খানম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিক্ষার্থীরা তাদের পড়ালেখা, ডিগ্রি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এই অবস্থায় অনেকে হতাশা ও বিষণœতায় আক্রান্ত। পরিবারের কেউ এই অবস্থার শিকার হলে অভিভাবকদের নজরদারি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত সেই ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাবে বলে তাদের আশ্বস্ত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর