মঙ্গলবার, ৬ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

খুন হননি তিনি

মির্জা মেহেদী তমাল

খুন হননি তিনি

৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধার মুখে স্কচটেপ লাগানো। হাত ও পা বাঁধা দড়ি দিয়ে। বিছানায় পড়ে আছেন। তার বুকের ওপর একটি বালিশ। পাশের কক্ষে ৪৫ বছর বয়সী তার মেয়ের লাশ। একটি সোফায় বসা অবস্থায় রয়েছে। গলায় ওড়না দিয়ে বাঁধা। পুরো বাসাটি তছনছ। ল-ভ- করে গেছে মুখোশধারী ডাকাত দল। আলমারি খুলে মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে তারা নিশ্চিত হয়ে গেছে, মা আর মেয়ে কেউ বেঁচে নেই। রাত ১০টায় ডাকাতি শেষে দুর্বৃত্তরা চম্পট। যাওয়ার আগে মূল দরজার বাইরে দিয়ে লক করে গেছে। রাত পেরিয়ে যায়। পরদিন সকালে হঠাৎ জ্ঞান ফিরে বৃদ্ধা মায়ের। কিন্তু তার হাত পা বাঁধা। নড়তে পারেন না। বেঁচে আছেন বিশ্বাসও করতে পারছেন না। মুখ তার বন্ধ বলে কোনো শব্দও করতে পারছেন না। তিনি শোয়া অবস্থাতেই চেষ্টা করছেন মুখের স্কচটেপ সরিয়ে ফেলতে। কিন্তু পারেন না। সারা রাত কেটে গেছে। দুর্বল লাগছে তার। কখন তিনি ঘুমিয়ে পড়েন টেরও পান না। ঘুম ভাঙে। একইভাবে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি নিজেকে মুক্ত করতে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করায় স্কচটেপের আঠা দুর্বল হতে থাকে। একটু ঢিলা হয়। হাত পায়ের বাঁধনেরও একই অবস্থা। তিনি চেষ্টা করতে থাকেন। পারেন না। একদম না খাওয়া। পানির তেষ্টায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছেন না। শরীর দুর্বল হতে থাকে। বৃদ্ধা নিজেই নিশ্চিত, হয়তো জীবনের শেষ সময়টা এভাবেই কেটে যাবে।

আবারও ঘুম পায় বৃদ্ধার। এক সময়ে ঘুমিয়েই পড়েন। ঘুম যখন ভাঙে তার, কোনো রকমে মাথা ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়িতে চোখ রাখেন। ভোর তখন ৬টা। এবার বৃদ্ধা ভাবছেন, যেভাবেই হোক তাকে এবার কিছু একটা করতে হবে। তিনি বিছানার সঙ্গে মুখ ঘষেন। স্কচটেপ একটু সরাতে পারেন। এরপর হাত ও পায়ের বাঁধন খুলতে নানাভাবে চেষ্টা করেন। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা ধরে বেঁচে থাকার এক যুদ্ধে তিনি জয়ী হন। তিনি মুক্ত করতে পারেন নিজেকে। হাত পায়ে বাঁধা দড়ি খুলে ফেলেন। কোনো রকমে বিছানা থেকে উঠে পাশের রুমে যান। মেয়েকে 

দেখতে পান সোফার ওপরে বসা। হাত পা ঠান্ডা। গলায় ফাঁস দেওয়া ওড়নাটাও আছে। তিনি মেয়েকে ডাকতে থাকেন। কিন্তু মেয়ের কোনো সাড়া নেই। দৌড়ে যান বারান্দায়। লোকজনের চলাচল তখনো শুরু হয়নি। ২/১ জন পথচারী দেখে বৃদ্ধা চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু তারা তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকেন। একটা সময় লোকজন শুনতে পায়। তারা ছুটে আসেন। বাড়ির দরজা বাইরে থেকে খুলে দেয়।

খবর শুনে ছুটে আসে পুলিশ। এ সময় বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পুলিশ বৃদ্ধার চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠায়। মেয়ের লাশ পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। ২০১২ সালের ৫ জুন রাত ৮টায় ডাকাতরা ২৭/১৩ নম্বর তিনতলা ভবনের নিচতলায় ঢুকে পড়ে। হত্যার জন্য বৃদ্ধা খালেদা বানুকে মারধরের পর বেঁধে ফেলে এবং মেয়ে নিশাত বানুকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। তবে ডাকাতদের ধারণা ছিল দুজনকেই তারা হত্যা করতে পেরেছে। ৩৬ ঘণ্টা পর বৃদ্ধা মাকে জীবিত অবস্থায় এবং মেয়েকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।

পুলিশ তদন্তে নামে। পুলিশ অনেকটাই নিশ্চিত ডাকাত দলের কাজ এটি। বৃদ্ধা খালেদা বানুরও ধারণা এটি ডাকাতরা করেছে। খালেদা বানু সুস্থ হওয়ার পর বাসায় ফিরে আসেন। তিনি ল-ভ- হয়ে থাকা বাসা গোছগাছ করেন। তিনি আলমারি খুলে দেখতে পান, স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা নিয়ে গেছে ডাকাতরা। আরও নিয়ে গেছে তাদের সম্পত্তির ৬টি দলিল। ঠিক তখনই খালেদা বানুর মনে নতুন চিন্তা আসে। দলিল কেন লুটে নেবে ডাকাতরা। তিনি পুলিশকে জানান। পুলিশ খুনের ঘটনায় নতুন একটি সূত্র খুঁজে পায়। খালেদা বানু তখন তার বোনজামাইকে সন্দেহ করেন। কারণ সেই বোনজামাই ধানমন্ডির বাসিন্দা বাদশাহ তাদের বাড়িটি কোনো কোম্পানিকে দিতে বলেছিলেন। খালেদা বানুর স্বামী অনেক আগেই বিদেশ চলে গেছেন। সেখানেই নতুন সংসার গড়েছেন। তার অপর দুই মেয়ে থাকেন আমেরিকা। এসব কারণে বোনজামাই তাদের সম্পত্তি নিয়ে মাঝে মধ্যেই কথা বলতেন। এ কারণে খালেদা বানুর সন্দেহ এ ঘটনাটি তিনি ঘটাতে পারেন। পুলিশ ধরে নিয়ে আসে বাদশাহকে। কিন্তু তার কাছ থেকে এসব বিষয়ে কোনো তথ্য খুঁজে পায় না। পুলিশ খালেদা বানুর কাছে আরও কিছু তথ্য চায়। খালেদা বানু তখন জানায়, তোপখানা রোডে তার মালিকানাধীন আপ্যায়ন রেস্তোরাঁটি ২০ বছর আগে ভাড়া নেয় সাইফুল ও সেলিম। তারা কখনো ভাড়া তো দেইনি, বরং ভাড়া চাইলে নানাভাবে হুমকি দিত। তার ধারণা, সম্পত্তির লোভেই সাইফুল ও সেলিম নিশাতকে হত্যা করেছে। পুলিশ দেরি করেনি। ধরে নিয়ে আসে সেই দুই ভাইকে। জেরার মুখে সব বলে দেয় তারা। খালেদা বানুর সম্পত্তির লোভে ভাড়াটিয়া সাইফুল ও সেলিম এই খুনের ঘটনা ঘটায় বলে জানায় তারা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর