হ্যালো, সাদ তুই কই? কে বিপু? আমি বাসায়। তুই এখনো বাসায়! আর আমরা এখানে তোর জন্য অপেক্ষায় আছি। তোকে কেন্দ্র করেই পিকনিকের আয়োজন করেছি। আর এখন তুই বলছিস, এখনো বাসায়। বিপুর কথা শুনে সাদ বলে, আমি আসতেছি এখনই। মায়ের সঙ্গে বিদায় নিয়ে আসছি। ও হ্যাঁ তুই মায়ের সঙ্গে বিদায় নিয়েই চলে আয়, বলে বিপু।
১৭ জানুয়ারি ২০১২ সাল। সেদিন সন্ধ্যায় বন্ধুর ফোন পেয়ে মায়ের কাছে পিকনিকের কথা জানায় সাদ। মা বলেন, সন্ধ্যায় আবার কিসের পিকনিক! তোর বাবা পিকনিকের কথা শুনলে রাগ করবে। সাদ বলে, আমি রাতে বাবা ফেরার আগেই ফিরব। আর বাবা যদি চলেই আসে, তুমি একটু ম্যানেজ করো মা। ছেলের এমন আবদারে রাজি না হয়ে পারেন না মা। বলেন, ঠিক আছে বাবা। তাড়াতাড়ি চলে আসিস। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় সাদ। সাদ চলে যাওয়ার পরই তার বাবা আমিনুল ইসলামের ফোন পান মা। রাতে তার বাসায় ফিরতে দেরি হবে। রাতে খেয়ে নিতে বলেছেন সবাইকে। ব্যবসার কাজে তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত।
রাজশাহীর ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম। একমাত্র ছেলে নাদিমুজ্জামান সাদ রাজশাহী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। রাজশাহী শহরেই তাদের বাসা। পিকনিকের কথা বলে বেরিয়ে যাওয়ার পর রাত গভীর হয়। সাদের মায়ের ভীষণ চিন্তা হয়। সাদের বাবা বাসায় ফিরে এলে সাদকে না পেয়ে রাগ করতে পারে। এমন সব চিন্তা মাথায় তখন সাদের মায়ের। এমন সময় সাদের ফোন। মা আমি আজ রাতে ফিরতে পারব না। পিকনিক শেষ হয়নি। সকালেই চলে আসব। বাবা যেন রাগ না করে। তুমি ম্যানেজ করো মা। এক নাগারে কথাগুলো বলে যায় সাদ। মা বলেন, রাতে থাকার দরকার কি। চলে আয় বাসায় বাবা। সাদ মায়ের কাছে আবারও অনুরোধ করে। মা রাজি হন।পরদিন সকালে বাসায় ফেরার কথা সাদের। কিন্তু সাদের খবর নেই। বেলা বাড়ে। সাদের বাবা-মার চিন্তাও বাড়তে থাকেন। সাদকে ফোন দেয়। কিন্তু সাদের ফোন বন্ধ। ভয় পান সাদের বাবা। ফোন বন্ধ কেন! নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছেন আমিনুল। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। আমিনুলের পরিবারে শুরু হয়ে যায় কান্নার রোল। সাদের মা কান্না করছে ছেলের জন্য। সন্তানের খোঁজে বিভিন্ন স্থানে খোঁজখবর নেন। আত্মীয় স্বজনদের বাসায় খোঁজ নেন। সাদের যে কজন বন্ধুকে তারা চেনেন, তাদের কাছেও খোঁজ করেন। কিন্তু কোথাও নেই সাদ। তবে সাদ কোথায় গেল! তার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে পিকনিকের কথা বলে বেরিয়ে গেল? কিছুই বুঝতে পারছেন না সাদের বাবা-মা। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা চলে আসেন খবর পেয়ে। সবাই খোঁজ করতে থাকেন। পুলিশকে জানান সাদের বাবা। পুলিশ একটি সাধারণ ডায়েরি করে তাদের চলে যেতে বলে। কিন্তু সাদের সন্ধানে পুলিশের কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। সাদের বাবা হতাশ। রাত আসে। আমিনুলের পরিবারে তখন মাতম। সাদের জন্য মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আমিনুলের সন্তান নিখোঁজের খবর চাউর হয়ে যায় শহরে।
পুলিশের কাছে আমিনুল বারবার ধরনা দেন। কিন্তু পুলিশের তৎপরতা বাড়ে না। বাধ্য হয়ে আমিনুল ইসলাম পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তার কাছে যান। পদস্থ ওই কর্মকর্তাদের নির্দেশে পুলিশের পুরো টিম সাদকে উদ্ধারে মাঠে নামে। কিন্তু কোনো কূলকিনারা করতে পারে না পুলিশ।
ব্যবসায়ী আমিনুলের এক বন্ধু তাকে বলেন, সাদ ইদানীং খারাপ ছেলেদের সঙ্গে চলাফেরা করছিল। কোয়েল ও সুইট নামে দুই তরুণের নাম বলেন সেই লোকটি। আমিনুল সন্তানের খোঁজে বিভিন্ন স্থানে ছোটাছুটি করতে থাকেন। সুইট আর কোয়েলের ফোন নম্বর জোগাড় করে কল দেন। ফোন দিলে কোয়েল নিজেকে সঠিক পরিচয় দিয়ে বলেন, সাদের ব্যাপারে সে কিছুই জানেন না। সে ঢাকায় থাকে। ফোন করলে একই কথা বলে কোয়েলও। পুলিশ সাদকে উদ্ধারে নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকে। সাদের পরিবারের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করতে থাকে। রাজশাহী শহরের প্রতিটি ছাত্রাবাস এবং সব কটি মেসে অভিযান চালায়। কিন্তু কোথাও কোনো খবর পাওয়া যায় না। পুলিশের সোর্সগুলো সাদের সন্ধানে কাজে আসছে না।
হঠাৎ সাদের মোবাইল থেকে কল আসে মায়ের কাছে। সাদের মা ফোন ধরেই বলেন, বাবা সাদ তুই কোথায়? কিন্তু অপর প্রান্তে একজন মেয়ের কণ্ঠ শুনে হতবাক সাদের মা। মেয়েটি নিজেকে মৌ পরিচয় দিয়ে বলে, আপনার সন্তানের স্ত্রী আমি। আমরা কক্সবাজার হানিমুনে আছি। চিন্তা করবেন না। খোঁজ করার দরকার নেই। যখন সময় হবে ফিরে আসব। এ কথা বলেই ফোন কেটে দেয় মেয়েটি। সাদের বাবা মা এ খবর পুলিশকে জানায়। পুলিশ ভীষণ দ্বন্দ্বে পড়ে। তারা ফোন কলের লিস্ট নিয়ে সাদের বন্ধুদের শনাক্ত করার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে চারদিন পেরিয়ে গেছে। হাল ছাড়ে না সাদের পরিবার। সাত দিন পর পুলিশ ফোন কলের সূত্র ধরে রাজশাহী শহরের একটি মেস থেকে ধরে নিয়ে আসে শাওন নামের এক তরুণকে। তাকে জেরা করা হয়। সে এক সময় বলে, সাদের নিখোঁজের ঘটনাটি তাদের এক বন্ধু অনীক জানে। সে ৪/৫ দিন আগে বিয়ে করেছে। কখনো শ্বশুরবাড়ি, আবার কখনো নিজের বাড়িতেই থাকে। পুলিশ দেরি করে না। ছুটে যায় অনীকের শ্বশুরবাড়িতে। পেয়ে যায় অনীককে। শাওন গ্রেফতারের পর থেকে সব কিছুই দ্রুত এগোতে থাকে। শাওন আর অনীক এক পর্যায়ে স্বীকার করে, সাদকে তারা মেরে ফেলেছে। তাদের নিয়ে র্যাব বেরিয়ে পড়ে। তাদের দেওয়া তথ্য মতে র্যাব ২৫ জানুয়ারি বিকালে রাজশাহীর শিরোইল মঠপুকুর এলাকার মাহমুদা বেগমের বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকে সাদের লাশ উদ্ধার করে। এই বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষেই সাদকে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের কয়েক দফা রিমান্ডে নেওয়া হয়। তাদের দেওয়া তথ্যে একটি ছাত্রাবাস থেকে রক্তমাখা ছোরা এবং সাদের ব্যবহৃত কাপড় চোপড় উদ্ধার করে। তারা জানায়, সুইট ও কোয়েল এই খুনে জড়িত। পুলিশ জানতে পারে, তারা রয়েছে ঢাকার মনিপুরিপাড়ার একটি মেসে। সেখানেই চলে র্যাবের অভিযান। পাকড়াও হয় সুইট ও কোয়েল। এরপর ধরা পড়ে বিপু আর মৌ। তাদের প্রত্যেককে জেরা শুরু করে তদন্তকারীরা। গ্রেফতারকৃতরা হলো- চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের আবদুল আলীমের ছেলে এবং সাদের বাল্যবন্ধু আল আওয়াল কোয়েল (২০), একই থানার রেজাউল করিম সেলিমের ছেলে সুইট রেজা (২১), নাচোলের গোলাবাড়ি কোয়াটারপাড়ার আলিম উদ্দিনের ছেলে মাসুদ আলী শাওন (১৯), রাজশাহী মহানগরীর টিকাপাড়া খুলিপাড়ার আবুল কালামের ছেলে কায়সার আহমেদ অনীক (২০), রামচন্দ্রপুর বাসার রোড এলাকার রবিউল ইসলাম বাবুর ছেলে রাশেদুল ইসলাম বিপু (২০) এবং সুইট রেজার গার্লফ্রেন্ড মহানগরীর হাজরাপুকুর এলাকার ইশরা হক ঐশী (১৯)। এদের গ্রেফতার করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজশাহী ছাড়াও, ঢাকা, টাঙ্গাইল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাচোলে ১০০ অভিযান পরিচালনা করে। কেন এই খুন? এমন প্রশ্নে খুনিরা স্বীকার করে খুনের আদ্যোপান্ত। তাদের প্রচুর টাকার প্রয়োজন স্বপ্ন পূরণে। তাদের স্বপ্ন রাজশাহীতে বাড়ি ও মোটরসাইকেল কিনবে। আরও উন্নতির জন্য স্বর্ণের ব্যবসা করবে বলেও ভেবেছিল। মূলত সাদকে অপহরণ ও হত্যা আর মুক্তিপণের টাকা আদায়ের জন্যই তারা শিরোইল মঠপুকুর এলাকার ওই বাড়িটি ভাড়া করেছিল। কীভাবে ঘটনাটি ঘটাবে, তার বুদ্ধি নিয়েছিল তারা ভারতীয় একটি অপরাধমূলক অনুষ্ঠান দেখে। আর কাকে অপহরণ করা যায়, এমন ভাবনার এক পর্যায়ে তারা রাজশাহী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র নাদিমুজ্জামান সাদকে টার্গেট করে। কারণ সাদের বাবা একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। ৫ কোটি টাকা তার কাছে কিছুই নয়। এ চিন্তা থেকেই সাদকে বাসা থেকে ডেকে আনে। ১৭ জানুয়ারি রাতেই তাকে ঘুমের ওষুধ মেশানো কোমল পানীয় পান করায়। সাদ ঘুমিয়ে পড়লে গলা টিপে হত্যার পর গলায় ছোরা চালিয়ে জবাই করে। লাশটি তারা প্রথমে খাটের নিচে লুকিয়ে রাখে। পরে সেখান থেকে বের করে নিয়ে সেপটিক ট্যাংকিতে ফেলে দেয়। রাজশাহী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র নাদিমুজ্জামান সাদ হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া তিন আসামির মৃত্যুদন্ডের সাজার পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছে হাই কোর্ট। সেই সঙ্গে যাবজ্জীবন দন্ড পাওয়া একজনের দন্ড বহাল রাখা হয়। বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এ এস এম আবদুল মবীনের হাই কোর্ট বেঞ্চ ২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট এই রায় দেয়।
রাজশাহী জেলা ও দায়রা জজ আদালত ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর তিন বন্ধু আল-আওয়াল কোয়েল, সুইট রেজা ও মাসুদ আলী শাওনকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়। এ ছাড়া অপর বন্ধু কায়সার আহমেদ অনীককে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড দেন। এরপর নিয়ম অনুসারে ডেথ রেফারেন্স হাই কোর্টে আসে এবং আসামিদের আপিল ও জেল আপিল করে। এসব বিষয়ে শুনানি শেষে রায় দেয় হাই কোর্ট। এর আগে ২০ মে রাজশাহী মহানগর হাকিমের আদালতে মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এতে সাদের ৫ বন্ধুসহ মোট ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।