সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

শিশুর কাঁধে শ্রমের বোঝা

ঝরছে ঘাম ঝরছে প্রাণ, আইন থাকলেও বন্ধ হচ্ছে না, মহামারীতে আরও বেড়েছে

জিন্নাতুন নূর

শিশুর কাঁধে শ্রমের বোঝা

করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং লোকসানের কারণে কারখানাগুলোতে কম বেতনে শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। শিশুশ্রমের বাজারে এখন শিশুদের জোগান আগের চেয়ে অনেক বেশি। বিভিন্ন কারখানায় মালিকরা আইন অমান্য করে যে শিশু শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে বাস্তবে এই জোগান আরও বেশি। এখন চাইলেই আগের চেয়ে বেশি শিশু শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে। আর জোগান বেশি হওয়ায় কম মজুরিতে শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এমনকি কম বেতনে কাজ পেয়েও শিশুরা তা করছে। অনেক শিশু কাজ না পেয়ে এখন কাজ খুঁজছে। সরকার শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরে আসতে ২০১৬ সালে প্রথম টার্গেট অর্জনে ব্যর্থ হয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত নতুন টার্গেট নির্ধারণ করে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম বন্ধে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুডস লিমিটেডের ছয়তলা ভবনের অগ্নিকান্ডে শিশুশ্রমের ভয়াবহ রূপ আবার সামনে উঠে এসছে। এ ঘটনায় কারখানাটির ৫২ শ্রমিকের মৃত্যু হয় যার অধিকাংশই ছিল শিশু-কিশোর।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই কারখানায় কর্মরত শিশুদের বয়স ছিল ১১ থেকে ১৮ বছর। করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অনেক শিশুকেই পরিবার থেকে এখানে কাজে পাঠানো হয়। কারখানা মালিকও কম মজুরিতে কাজ করানোর জন্য শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ দেন। দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও শিশুদের দিয়েই চলছিল এই জুস কারখানাটি। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা এখানে ৩ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা বেতনে কাজ করত।

অথচ শ্রম মন্ত্রণালয় ও এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে কল-কারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের কাজই হচ্ছে বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শন করা। সেখানে শিশুদের নিয়োগ করা হচ্ছে কিনা তা নজরদারি করা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো এই নজরদারির কাজ সবসময় না করে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই শুধু তৎপর হয়। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে কাজে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে দেশে বিদ্যমান সরকারি আইনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাপ্ত খবরে করোনায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে উল্লেখযোগ্য শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তারা সরকারি বা এনজিও পরিচালিত স্কুলে যেত। কিন্তু মহামারীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় এবং সংসারে অসচ্ছলতা থাকায় দরিদ্র এই শিশুদের পক্ষে স্কুলে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে এই শিশুরা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে। তারা আগে পার্টটাইম কাজ করলেও এখন ফুলটাইম কাজ করছে। আর ১৫-২০ বছর পর এই শিশুরা যখন বড় হবে তখন তারা দেশের জন্য বাড়তি বোঝায় পরিণত হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সূত্রে সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ২০১৬ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত দেশে সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু কর্মরত ছিল। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ শিশুর কাজ শিশুশ্রমের আওতায় পড়ে। আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিল ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। ২০২০ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং আইএলওর অর্থায়নে দেশে শিশুশ্রম নিয়ে আরেকটি জরিপ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মহামারীর কারণে এ কাজটি শুরু হয়নি। কাজটি কবে নাগাদ শুরু হবে তাও জানা নেই।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের উদ্যোগে ‘কভিড-১৯ এর প্রভাবে ঢাকায় কর্মরত শ্রমজীবী শিশুদের অবস্থা যাচাই’ শীর্ষক জরিপ থেকে জানা যায়, করোনায় অনেক শিশু পেশা পরিবর্তন করেছে। যেসব শিশু আগে কাজ করত এমন ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশের এখন কাজ নেই। আর এমন ৩১ শতাংশের ওপর শিশুগুলোর পরিবার নির্ভরশীল। এদের মধ্যে ৩২ শতাংশ মহামারীতে কোনো সরকারি-বেসরকারি সাহায্যও পায়নি।

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু : এরই মধ্যে সরকার মালিক, শ্রমিক ও সুশীল সমাজের সঙ্গে কথা বলে ৩৮টি কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করলেও এসব কাজে এখনো শিশুদের দেখা যাচ্ছে। এসব কাজের মধ্যে অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে যে শিশুরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গ্রিজ, কেরোসিন, মবিল ব্যবহার করে যন্ত্রপাতির কাজ করছে তারা প্রায়ই কোনো না কোনো শারীরিক আঘাত পাচ্ছে। এতে তাদের চামড়ায় প্রদাহ হচ্ছে। হাতে গ্যাংগ্রিন হচ্ছে, শ্বাসনালির সংক্রমণ এবং হাঁপানি হচ্ছে। বিড়ি ও সিগারেট তৈরির কারখানা যারা কাজ করছে তারা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়, পাকস্থলীতে ঘা, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ সমস্যায় ভুগছে। ইট ও পাথর ভাঙার কাজ করে যে শিশু তারাও প্রায় দিন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। তাদের শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তি  হ্রাস পাচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ বা লেদ মেশিনে যারা কাজ করছে তাদের শিরায় রক্ত জমাট, চোখের প্রদাহ ও দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় ভুগছে। ম্যাচ তৈরির কারখানায় যে শিশুরা কাজ করে তাদের আঙুলে ঘা, বাতজনিত সমস্যা ও শ্বাসতন্ত্রেও রোগ হয়। আর প্লাস্টিক তৈরির কারখানায় যারা কাজ করে তাদের শুষ্ক কাশি, নিউমোনিয়া, হাঁপানি, ফুসফুসের প্রদাহ হয়। সাবান তৈরির কারখানার কাজে চুলকানি, হাত-পায়ের আঙুলে ক্ষত, কাশি, নিউমোনিয়া ও হাঁপানি হয়। ট্রাক বা টেম্পো ও বাসের হেল্পার যে শিশুরা তারা সড়ক দুর্ঘটনা, ওজন কমা, কোষ্ঠকাঠিন্য, শ্রবণশক্তি হ্রাস, শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়ার সমস্যায় ভুগে। বিস্কুট ফ্যাক্টরি বা বেকারিতে যে শিশুরা কাজ করে তাদের মাথাব্যথা, বমি হওয়া, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, ক্ষুধামন্দা, পাকস্থলীতে ঘা, যকৃতে প্রদাহ হয়।

শ্রমজীবী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে প্রত্যাহারের লক্ষ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছে। শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিকের একটা বড় অংশই শিশু। ফলে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। শিল্প খাতকে শিশুশ্রম মুক্ত ঘোষণা করার লক্ষ্যে একটি জাতীয় কোর কমিটি গঠন  করা হয়েছে। এত কিছুর পরও শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ সহিদ মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাইলেও সরকার তা পারবে না। শিশুশ্রম বন্ধে সরকার ২৮৪ কোটি টাকার প্রকল্পও গ্রহণ করেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল ১ লাখ শ্রমিককে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে মুক্ত করা। আর এটি বাস্তবায়ন করার কথা বিভিন্ন বাছাইকৃত এনজিওর। ২০২১ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা, কিন্তু এখনো এনজিও বাছাইয়ের কাজই শেষ হয়নি। আবার বেশ কয়েকবার এই প্রকল্পের পরিচালককেও পরিবর্তন করা হয়েছে। করোনায় এর কাজ আরও দীর্ঘায়িত হবে বলে আশঙ্কা করছি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর