বৃহস্পতিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

নালায় ডুবে মৃত্যুর দায় কার

নাবিকের অসতর্কতার দোষ সমুদ্রের নয় : মেয়র

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম মহানগরের বহদ্দারহাট থেকে বাস টার্মিনাল পর্যন্ত সড়ক। সড়কের দক্ষিণ পাশে প্রায় ১ কিলোমিটার ২০ ফুট প্রস্থের নালা। নালার ওপর অধিকাংশ স্থানে নেই কোনো স্লাব। মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে আছে বড় আকারের খোলা নালা। সেখানেও নেই কোনো স্লাব। এভাবে মুরাদপুর থেকে ২ নম্বর গেট পর্যন্ত সড়কের দুই পাশ, আগ্রাবাদ চৌমুহনী থেকে বাদামতল মোড়, এক্সেস রোডের দুই পাশ, পোর্ট কানেকটিং রোড, সিরাজুদ্দৌলা রোড, বাদুড়তলা সড়ক, কে বি আমান আলী রোড, চকবাজারসহ নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সড়কের পাশে থাকা নালা-নর্দমা ও ড্রেনে নেই কোনো স্লাব বা নিরাপত্তা-বেষ্টনী। এ ছাড়া সড়কের পাশে থাকা খালের পাড়ে কোনো নিরাপত্তা দেয়াল নেই। নগরের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। এভাবে নগরের অধিকাংশ নালা-নর্দমা, ড্রেনের ওপর এবং খালের পাশে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় গর্ত, নালা-নর্দমা, ড্রেন ও খালে পড়ে নিখোঁজ হচ্ছে এবং প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। নালা-নর্দমাগুলো যেন মরণফাঁদ। প্রাণহানি হলেও এর দায় নিচ্ছে না কোনো সেবা সংস্থা। বরং সংস্থাগুলো পরস্পরকে দোষারোপ করছে। সর্বশেষ সোমবার রাতে আগ্রাবাদ বাদামতল মোড়ের পূর্বে খোলা নালায় পড়ে প্রাণ হারান আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া।

জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরে নালা-নর্দমায় পড়ে প্রাণ হারানোর ঘটনা নতুন নয়। শহরজুড়েই সড়কে সড়কে মেলে খোলা নালার অস্তিত্ব। ২৫ আগস্ট মুরাদপুর মোড়ে পা পিছলে নালায় পড়ে মুহুর্তেই পানির স্রোতে তলিয়ে যান ব্যবসায়ী সালেহ আহমদ (৫০)। এক মাস পার হলেও মেলেনি ওই ব্যবসায়ীর খোঁজ। এর আগে ৩০ জুন নগরের মেয়র গলির চশমা খালে পড়ে মারা যান অটোরিকশার চালক সুলতান (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগম (৬৫)। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই আগ্রাবাদ সিঅ্যান্ডবি কলোনির পাশে বিল্লাপাড়ায় জলাবদ্ধতার সময় নালায় পড়ে অটোরিকশাচালক ও যাত্রীর মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালের ২ জুলাই রাতে এম এম আলী রোডের নালায় পড়ে মারা যান সরকারি কর্মকর্তা শীলব্রত বড়ুয়া। ২৫ আগস্ট মুরাদপুরে নালায় ব্যবসায়ী নিখোঁজের পর চসিক নগরের নালা-ড্রেনে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু ঘটনাস্থল বাঁশ দিয়ে ঘেরাও দেওয়া ছাড়া আর কোথাও কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। একইভাবে সোমবারের ঘটনার পরও ঘটনাস্থলে বাঁশ দিয়ে ঘেরাও দেওয়া হয়। এখানকার নালা-ড্রেনও ছিল উন্মুক্ত। ঝুঁকি নিয়েই মানুষ চলাচল করত। ২৯ আগস্ট চসিকের ষষ্ঠ পরিষদের সপ্তম সাধারণ সভায়ও নগরের নালা-ড্রেন সংস্কার নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বর্তমানে নগরের পতেঙ্গা থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল, নালা-নর্দমা পরিষ্কারে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। অভিযোগ আছে, একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় না। বরং ঘটনা ঘটার পরই লোক দেখানো কিছু তৎপরতা থাকে। এরপর সব হারিয়ে যায়। প্রাণহানির ঘটনাস্থলে বাঁশ দিয়ে ঘেরাও দেওয়া হলেও আশপাশের এলাকাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। এতে যে কোনো সময় প্রাণহানির শঙ্কা থেকে যায়। বারবার প্রাণ হারালেও টনক নড়ছে না চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক)। উল্টো দুই সংস্থার মধ্যে এখন চলছে কাদা ছোড়াছুড়ি। দায় এড়াতে দুষছেন একে অন্যকে। চট্টগ্রামবাসী চান সেবা সংস্থাগুলো দায় চাপানোর সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসুক।

চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই সিডিএ চসিকের ওপর দায় চাপায়। অথচ নিয়মমতে যারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন, প্রাথমিকভাবে তাদেরই দায়িত্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যদি সিডিএ দায় এড়াতে চায় তাহলে তারা চসিককে চিঠি দিক। চসিক এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে।’ তিনি বলেন, ‘দেওয়ানহাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করছে সিডিএ। এখন এগুলো চসিকের নিয়মিত কাজের আওতায় নেই। কাজের সময় রক্ষণাবেক্ষণ করবে সিডিএ। এ ছাড়া কাজের সব ময়লা পড়ছে নালায়।’

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘ঘটনাস্থলে আগে থেকেই স্লাব ছিল না। যেটুকু স্লাব দেখা যাচ্ছে তা সিডিএ করছে। সেখানে আগে চসিকের ডাস্টবিন ছিল। হাঁটার জায়গাও ছিল না। নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে এসব নালা-নর্দমা ও ড্রেনে চসিকের স্লাব বসানোর এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার কথা। এ ছাড়া চসিক নিয়মিত নালা-নর্দমা পরিষ্কার করলে সেখানে বর্জ্যরে ভাগাড় হতো না।’

নালায় পড়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে যা বললেন সিটি মেয়র : আগ্রাবাদে নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছেন, ‘সমুদ্রে যখন জাহাজ চলে তা যদি নাবিকের অসতর্কতার কারণে দুর্ঘটনাকবলিত হয় তা তো সমুদ্রের দোষ হতে পারে না। অনুরূপ যারা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তারা জননিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতে না পারলে তা প্রকল্পের দোষ নয়।’ গতকাল নগর ভবনে আয়োজিত সাধারণ সভায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় করপোরেশনের বিরুদ্ধে দোষারোপকারীদের উদ্দেশে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল আলমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন প্যানেল মেয়র আবদুস সবুর লিটন, মো. গিয়াস উদ্দিন ও আফরোজা কালাম, চসিক সচিব খালেদ মাহমুদ, প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। সিটি মেয়র বলেন, নগরে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আন্তঃসংস্থাগুলোর উন্নয়ন কর্মকান্ডের সমন্বয় সাধন ও সম্পাদনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে কর্তৃত্ব প্রদানের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারের ভাবমূর্তি ও প্রকৃত জনস্বার্থ রক্ষায় আমার পূর্বসূরি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী যে ভূমিকা পালন করেছিলেন আমি তা করতে চাই। এ জন্য দল-মতনির্বিশেষে সবার সহযোগিতা কামনা করি।

এ দায়িত্বহীনতা গণহত্যার শামিল, দায় সব সংস্থার

উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য দরকার যৌথ টাস্কফোর্স গঠন

বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করা উচিত

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর