ঘরের বাইরে কোনো কিছুর শব্দে ঘুম ভাঙে রুবিয়ার। পাশেই ঘুমিয়ে ছিল তার বোন আফিয়া। কিন্তু খাটে সে নেই। খাট থেকে নেমে রুবিয়া আলো জ্বালাতেই চোখ যায় ঘরের ডান দিকে। আঁতকে ওঠে। বড় করে সিঁধ কাটা। ঘরে নেই আফিয়া। অজানা আশঙ্কায় চিৎকার করে ওঠে রুবিয়া। বাবা, ও বাবা ওঠেন। ঘরে সিঁধ কাটছে কে? আফিয়া, ও আফিয়া। গভীর রাতে এমন চেঁচামেচিতে রুবিয়ার বাবা আজহার আলীসহ ভাই, বোনের জামাই সবাই ঘুম থেকে জেগে ওঠে। ঘরের কোথাও নেই আফিয়া। পরিবারের সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আফিয়ার খোঁজে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তারা দেখতে পায় ঘরের পেছনে একটি কচুক্ষেতের পাশে পড়ে আছে আফিয়া। মাথা ফাটা। গলায় গামছা প্যাঁচানো। তার পরনের কাপড় ছেঁড়া। আফিয়াকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাটি নরসিংদীর পলাশের গজারিয়া ইউনিয়নের চরকাবরদী গ্রামের। ২০২০ সালের ১৮ মার্চের রাতে ঘটনাটি ঘটে।
দশম শ্রেণির মাদরাসাছাত্রী আফিয়াকে এভাবে হত্যার পর গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। এ ঘটনায় মামলা করেন আফিয়ার বাবা। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ঘটনাটি কি কোনো চোরের কাজ, নাকি খুনের জন্যই এভাবে সিঁধ কেটে ভিতরে ঢোকে দুবর্ৃৃত্তরা; এটি পুলিশের কাছে বড় প্রশ্ন। পুলিশ তদন্তের শুরুতেই আফিয়ার বোনের জামাইসহ ওই বাড়ির চারজনকে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ ঘটনার বিষয়ে কোনো তথ্য পায় না।
মামলার তদন্ত এগোয় না। খুনিকে শনাক্ত করতে পারে না পুলিশ। এরপর মামলার তদন্তভার ন্যস্ত করা হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ওপর। পিবিআই তদন্ত করতে যেয়ে আফিয়ার ফোনের কল লিস্ট পরীক্ষা করে। সেখানে দেখতে পায় একটি নম্বর থেকে খুব বেশি কল এসেছে। ওই নম্বরে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলতেন আফিয়া। পুলিশ সেই নম্বরের মালিক রাসেলের খোঁজ করতে থাকে। ইতিমধ্যে পেরিয়ে যায় ছয় মাস। পিবিআই রাসেলের অবস্থান খুঁজে পায় না। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআই ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ, দোহারসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। কিন্তু সবগুলোই ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে দীর্ঘ এক বছর পর পিবিআই রাসেলের নাগাল পায়। প্রাপ্ত তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় গাজীপুর মহানগর এলাকার কোনাবাড়ী আমবাগ এলাকায় স্বপ্নপুরী মার্কেটের সামনে থেকে রাসেলকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল স্বীকার করে তার প্রেম ভালোবাসা এবং খুনি হওয়ার নানা কাহিনি।রাসেল গজালিয়া দারুল উলুম দাখিল মাদরাসার নতুন বিল্ডিং ভবনের কনস্ট্রাকশন কজের রাজমিস্ত্রি শ্রমিক হিসেবে কাজ করত। আফিয়া খাতুন ওই মাদরাসার দশম শ্রেণির ছাত্রী। তার বাড়ি মাদরাসার পাশে হওয়ায় রাসেল বাড়ির পাশ দিয়ে দোকানে আসা-যাওয়ার সুবাদে আফিয়া খাতুনের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং দুজনের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। তাদের সম্পর্ক শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ায়। রাসেল গজারিয়া এলাকায় আরও একাধিক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। আফিয়ার সঙ্গে প্রেমের গভীর সম্পর্কের ফলে তাদের মাঝে একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক হয়। কিন্তু রাসেল এরপর একই গ্রামের একই মাদরাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী আখিনুরের সঙ্গেও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিছু দিন পর আখিনুরকে নিয়ে ঢাকায় পালিয়ে যায়। কয়েক দিন পর রাসেল আখিনুরকে নিয়ে নরসিংদী সদরে শালিধা এলাকায় রুম ভাড়া করে থাকে।
রাসেল আফিয়ার সঙ্গে আবার মোবাইল ফোনে কথা বলা শুরু করে। একই গ্রামের আখিনুরকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করায় আফিয়ার সঙ্গে রাসেলের অনেক ঝগড়া বিবাদ হয়। ঝগড়ার রেশ ধরে রাসেল গত সেই রাতে আফিয়ার বাড়িতে যেয়ে সুযোগ বুঝে ঘরে ঢোকার জন্য ওতপেতে বসে থাকে। দরজা বন্ধ থাকায় ঘরে প্রবেশ করতে না পেরে আফিয়ার ঘরে সিঁধ কেটে ঢুকে পড়ে। পাশের রুমে পরিবারের অন্যরা ঘুমাতে থাকায় আফিয়াকে ঘর থেকে বের করে বাড়ির পেছনে খড়ের পালার পাশে রেখে ধর্ষণ করে। আফিয়ার সঙ্গে থাকা ওড়না দিয়ে গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে ও ইটের আধলা দিয়ে আফিয়ার মাথায় দুটি আঘাত করলে আফিয়া ঘটনাস্থলে মারা যায়। রাসেল আফিয়ার পরিহিত সেলোয়ার কামিজ ছিঁড়ে পালিয়ে যায়। উদ্দেশ্য পুলিশের দৃষ্টি অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য এবং সবাই যাতে মনে করে সিঁধ কাটা চোর এই ঘটনা ঘটিয়েছে এবং এই ঘটনা কোনো চোরের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে।