বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের সব আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে বজ্রকণ্ঠের অগ্নিঝরা মিছিল আর বিক্ষোভের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জোগাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিকর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স-স্টুডেন্টস সেন্টার-টিএসসি (ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র) থেকেই আবর্তিত হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সাংস্কৃতিক জাগরণ। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে সব আন্দোলনের নেপথ্যেই ছিল টিএসসি। মধুর ক্যান্টিন যেমন ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার, তেমনি টিএসসিও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ভূমিকা পালন করছে।
তবে করোনা মহামারীর কারণে গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে টিএসসির সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। প্রতিদিন নাটকের মহড়ায়, আবৃত্তির প্রশিক্ষণ, নাচ ও গানের রিহার্সেলে যে টিএসসি সরব থাকত, করোনার থাবায় শিল্পের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়া সেই টিএসসিজুড়ে এখন শুধু হাহাকার। করোনার থাবায় ক্ষতিগ্রস্ত নাটক, আবৃত্তি, নাচ, ফটোগ্রাফিসহ প্রায় অর্ধশতাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের টিএসসি। ফলে হতাশার মধ্যে রয়েছেন টিএসসি কেন্দ্রিক সংস্কৃতিকর্মীরা।
টিএসসির পরিচালক সৈয়দ আলী আকবর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনার কারণে সব সেক্টরই ক্ষতিগ্রস্ত। এই মহামারীর কারণেই এখন পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে টিএসসি কেন্দ্রিক আমাদের সব কার্যক্রম। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় এখনো বন্ধ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল খোলা না হলে টিএসসির কার্যক্রমও বন্ধ থাকবে। আমাদের মেডিকেল সেন্টারে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করছি এবং টিএসসির ওয়াশরুমসহ বিভিন্ন কাজের সংস্কার করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর টিএসসির প্রয়োজনীয় কিছু মেরামত করা হবে। এরপর হয়তো আমরা সংস্কৃতিচর্চার জন্য টিএসসিকে উন্মুক্ত করে দিতে পারি। তবে, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, তারা নিয়মিত টিএসসিতে তাদের জোটের অফিসে বসছেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪৭ বছর পর ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয় টিএসসি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সংস্কৃতির চর্চা বিকাশে এগিয়ে আসে এই প্রতিষ্ঠানটি। এটির প্রথম পরিচালক এ জেড খানের (আমানুজ্জামান খান) পৃষ্ঠপোষকতা ও আন্তরিক সহযোগিতার ফলে অল্প সময়েই ব্যাপক বিস্তার ঘটে টিএসসির সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর ’৫৬ সালে গঠিত হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক সংসদ’। আর এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) কার্যক্রম শুরু করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে টিএসসিতে নাট্যচর্চা শুরু করে বিভিন্ন নাট্যদল। আশির দশকে আবৃত্তি সংগঠনগুলো এখানে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। আবৃত্তি সংগঠন কণ্ঠশীলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-প্রশিক্ষক মীর বরকত বলেন, টিএসসিতে প্রতিষ্ঠা হলেও তারা কণ্ঠশীলনের কার্যক্রম বর্তমানে সারা দেশেই ছড়িয়ে দিয়েছেন। বাচিক ও আঙ্গিক আবৃত্তির ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন জেলায় কণ্ঠশীলন প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে বলেও জানান তিনি। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে টিএসসিতে আবারও আবৃত্তির মহড়া ও প্রশিক্ষণ নিয়ে সরব হবে কণ্ঠশীলন। কয়েক দশক ধরে যেসব সাংস্কৃতিক সংগঠন টিএসসিতে সংস্কৃতিচর্চা করছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আবৃত্তি সংগঠনগুলো হলো-বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, কণ্ঠশীলন, স্বরশ্রুতি, চারুবাক, চারুকণ্ঠ, প্রজন্মকণ্ঠ, স্রোত, বৈকুণ্ঠ, মুক্তধারা ইত্যাদি। সংগীতের সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠী, ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, বহ্নিশিখা, স্ব-ভূমি, বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী, রৌদ্র করোটি ইত্যাদি। নাটকের দলের মধ্যে রয়েছে ঢাকা পদাতিক, পদাতিক নাট্য সংসদ টিএসসি, লোক নাট্যদল টিএসসি, দৃষ্টিপাত নাট্য সংসদ, দৃষ্টিপাত নাট্যদল ইত্যাদি।