সোমবার, ৪ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

খুন করেই নাটক

মির্জা মেহেদী তমাল

খুন করেই নাটক

দিন শেষে সন্ধ্যায় স্বামী-সন্তানদের নিয়ে ঘরে সময় কাটাচ্ছিলেন পপি রানী কুন্ডু। কিন্তু কে জানত নিরাপদ ঘরের মধ্যে জমদূত হয়ে ছিল একটি বিদ্যুতের ছেঁড়া তার। সেই তারে জড়িয়ে মুহূর্তেই জ্ঞান হারালেন পপি রানী। পপিকে নিয়ে ঘরের মধ্যে তখন কান্নাকাটি। কী করবে বুঝতে পারছিলেন না কেউ। চোখের সামনে স্ত্রীর এভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলায় ভয় পান সুবল কুন্ডু। তাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির অন্য ঘর থেকে সুবলের ভাই বউদি ছুটে আসেন। তারা পপিকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক পপিকে মৃত ঘোষণা করেন। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর সার্টিফিকেটসহ সুবল স্ত্রীর লাশ নিয়ে বাড়িতে যান। লাশের সৎকার করেন। এ ব্যাপারে যশোর কোতোয়ালি থানায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়। যশোরের গাইদগাছি গ্রামের ঘটনা এটি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পপি রানী বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান।  স্ত্রীর মৃত্যুর পর ভেঙে পড়েন সুবল। দিন যত কাটছিল, স্ত্রীর শোকের রেশও কমছিল। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে সব কিছু। তার নাবালক তিন সন্তান নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকেন সুবল।

সব কিছু চলছিল ঠিকঠাক। নয় মাস পর পপি রানীর মৃত্যুর ঘটনাটি হঠাৎ সামনে চলে আসে। ফরেনসিক বিভাগ থেকে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন যায় থানা পুলিশের কাছে। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, পপি রানীর মৃত্যু বিদ্যুৎস্পৃষ্টে হয়নি, তাকে খুন করা হয়েছে। পুলিশকে ভাবিয়ে তোলে এই প্রতিবেদন। যে ঘটনাটি মানুষ ভুলতে যাচ্ছিল সেটি আবার সামনে চলে এসেছে। থানা পুলিশ এই প্রতিবেদনের খবরটি সুবলের কাছে পৌঁছায়। এরপর সুবল এবং তার পরিবারের মধ্যে শুরু হয় অস্থিরতা। এ ঘটনার ব্যাপারে যশোর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন পপির বাবা। হত্যা মামলাটি তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

পুলিশ তদন্তের শুরুতেই সুবলদের পরিবারকে নজরদারির আওতায় নেয়। তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের পর পিবিআই এক রকম নিশ্চিত যে, খুনের সঙ্গে জড়িত সুবল। তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। জেরার মুখে সব কিছুই ফাঁস করে দেয়। ১৮ বছর আগে তিনি মাগুরার শালিখা উপজেলার শরশুনা গ্রামের সুশান্ত কুন্ডুর মেয়ে পপি রানীকে বিয়ে করেন সুবল। দাম্পত্য জীবনে এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক-জননী তারা। সুবল কুন্ডু শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে স্ত্রী পপি রানী প্রায়ই স্বামী সুবলকে বিভিন্ন ধরনের কটু কথা বলতেন। ২০২০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে তারা স্বামী-স্ত্রী রান্নাঘরে বসে তরকারি কাটছিলেন। এ সময় সুবলকে বলে ‘তুমি মরে যেতে পারো না?’ এ ছাড়া পপি আর সুবলের সংসার করবে না বলে জানায়। এ সময় রান্নাঘরের পাশে থাকা একটি নারিকেলের গাবড়া দিয়ে পপিকে মাথায় আঘাত করেন। পপি মাটিতে পড়ে গেলে শ্বাসরোধে হত্যা করে সুবল। এ সময় ঘরে থাকা বড় মেয়ে পিংকি রানী কুন্ডু সেখানে আসে। তারপর সুবলের ছোট ভাই মিলন কুন্ডুর স্ত্রী ডলি কুন্ডু এগিয়ে আসে। মেয়ে পিংকি বলে উঠে- ‘বাবা কি করলে?’ আমি বাঁচার কথা বললে ডলি কুন্ডু নাটক সাজানোর পরামর্শ দেন। এবং বৈদ্যুতিক শকে পপির মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করতে হবে। এরপর পপিকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে পপিকে শ্বাসরোধে হত্যার কথা উল্লেখ থাকায় পপির পিতা সুশান্ত কুন্ডু অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন।

ওই মামলাটি প্রথমে কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক (অপারেশনস) সুমন ভক্ত তদন্ত করেন। পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এসআই ¯েœহাশিষ তদন্তের দায়িত্ব পান। গত ২৯ জুন বাড়ি থেকে পুলিশ সুবলকে আটকের পর ৩০ জুন আদালতে সোপর্দ করা হয়। এ সময় স্ত্রী পপি রানীকে দাম্পত্য কলহের বিষয় নিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন সুবল।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর