দেশে কয়লা আমদানির অন্যতম ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট স্থলবন্দর শুল্ক কর্মকর্তারা চোখের আন্দাজে রাজস্ব আদায় করেন। দীর্ঘদিন থেকে ওজন মাপার যন্ত্র নেই হালুয়াঘাটের দুই স্থলবন্দরে। ভারত থেকে আসা কয়লাভর্তি ট্রাকের ওজন না মেপে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। এতে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। এই দুই স্থলবন্দরের মধ্যে রয়েছে গোবরাকুড়া ও কড়ইতলি স্থলবন্দর। এর মধ্যে গোবরাকুড়া বন্দর থেকে অধিকাংশ কয়লা আমদানি করা হয়। চোখের আন্দাজ আর ভারতীয় শুল্ক বিভাগ থেকে লিখে দেওয়া ওজনকে সত্য মেনে রাজস্ব আদায় করেন সংশ্লিষ্ট শুল্ক কর্মকর্তারা। ফলে রাজস্ব ফাঁকির পুরনো অভিযোগ থেকে বের হতে পারছে না এই দুই বন্দর। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, গোবরাকুড়া বন্দর দিয়ে গত বছর কয়লা আমদানি করা হয়েছে ৩৫ হাজার ৮০৬ টন। রাজস্ব আদায় হয়েছে ৭ কোটি ৭৫ লাখ ২৯ হাজার টাকা। অভিযোগ আছে, কয়লা আমদানিকারক আর শুল্ক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এই সময়ে সোয়া পাঁচ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়। বন্দরসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রতিটি ট্রাকে ২০-২২ টন কয়লা ভারত থেকে আসে। কিন্তু শুল্ক আদায় হয় গড়ে প্রতি ট্রাকে ১২ টন কয়লা ধরে। এতে আমদানিকারক প্রতিটি ট্রাকে প্রায় আট টন কয়লার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন। টাকার অঙ্কে তা ১৭ হাজার ৩২২ টাকা। গোবরাকুড়া থেকে আট মাইল দূরে অবস্থিত কড়ইতলি বন্দর। গত বছর এই বন্দর দিয়ে কয়লা এসেছে ২৩ হাজার টন। এখানেও প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পাওয়ায় এই দুই স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা কয়লা কিছুটা কম দামে বিক্রি করে দ্রুত লাভবান হচ্ছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীরা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের অন্য বন্দর থেকে আমদানি করা বা যারা নিয়ম মেনে আমদানি করছেন সেসব ব্যবসায়ী। তারা যথাযথ শুল্ক দিয়ে অন্য স্থলবন্দর ও সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি করেন কয়লা। এই দুই বন্দরে মান দেখার সুযোগ না থাকায় নিম্নমানের কয়লাও ঢুকছে দেশে। মূলত ইটভাটায় এসব কয়লা ব্যবহার করা হয়। সরেজমিন দেখা গেছে, ভারত থেকে কয়লা নিয়ে ঢুকছে একের পর এক ট্রাক। প্রবেশপথে দায়িত্বরত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা ট্রাকে কোনো অবৈধ মালপত্র আছে কি না, তা তল্লাশি করে দেখছেন। এরপর কয়লার চালানের কাগজপত্র দায়িত্বরত কাস্টমস ও ভ্যাট কর্মকর্তাকে দেখিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ট্রাকগুলো। কোনো ট্রাকের কয়লা মাপা হয়নি। ৪ জানুয়ারি এই প্রক্রিয়ায় অর্ধশত ট্রাক কয়লা নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে গোবরাকুড়া স্থলবন্দর দিয়ে। ট্রাক থেকে কয়লা নামানোর কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা জানান, তাঁদের হিসাবে প্রতি ট্রাকে ২০-২২ টন কয়লা ধরে। তাঁরা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে তা ট্রাক থেকে নামান। বর্তমানে প্রতি টন কয়লা থেকে ২১৬৫.২৫৭ টাকা রাজস্ব পায় সরকার। সেই হিসাবে প্রতি ট্রাকেই ১৭ হাজার ৩২২ টাকার বেশি রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন অসাধু আমদানিকারকরা। এই দুই বন্দর দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ ছিল ওই এলাকার এমপি জুয়েল আরেং এবং হালুয়াঘাট উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলী আজগরের হাতে। গত বছর করোনায় আক্রান্ত হয়ে আলী আজগর মারা যাওয়ার পর জুয়েল আরেংয়ের একক নিয়ন্ত্রণে চলে যায় বন্দর। তিনি গোবরাকুড়া স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি। অসাধু প্রক্রিয়ার কারণে বন্দর থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া এক আমদানিকারক জানান, গোবরাকুড়া আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সদস্য তিন শতাধিক। কিন্তু এখন সক্রিয় আছেন মাত্র ১১০ জন। কারণ বন্দরে শুধু এমপির লোকজনই ব্যবসা করতে পারেন। অনেক ব্যবসায়ী চাইলেও প্রয়োজনমতো কয়লা আমদানি করতে পারেন না বলে জানান। কেউ কেউ তাই বন্দর থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। বন্দরের লোড-আনলোড এলাকায় গিয়ে এই ব্যবসায়ীর অভিযোগের সত্যতা মেলে। মেসার্স দত্ত অ্যান্ড ব্রাদার্স, বাংলা ইন্টারন্যাশনাল, সেতু ইন্টারন্যাশনাল, ফ্রেন্ড ইন্টারন্যাশনাল, আনিতা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স সিদ্দিক ইন্টারন্যাশনাল, আবির ট্রেডার্স, মেসার্স বড় ভাই এন্টারপ্রাইজসহ অনেক ডিপো খালি পড়ে থাকতে দেখা যায়। ৫ জানুয়ারি উপজেলার কড়ইতলি স্থলবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, আমদানি করা কয়লার ওজন যাচাই না করে শুধু এলসিপত্র দেখিয়ে একের পর এক ট্রাক বাংলাদেশে ঢুকছে। এই বন্দরের নিয়ন্ত্রণে আছেন এমপি জুয়েল আরেংয়ের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ১ নম্বর ভুবনকুড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সুরুজ মিয়া। কড়ইতলি কোল অ্যান্ড কোক ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তিনি। বিষয়টি নিয়ে দুই স্থলবন্দরের কোনো শুল্ক কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। গোবরাকুড়া আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অশোক সরকার অপু ওরফে অপু সরকার গণমাধ্যমকে বলেন, ভারতীয় বন্দরে প্রতিটি ট্রাক ওজন স্কেলে পরিমাপ করে তবেই বাংলাদেশে পাঠানো হয়। তাই নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কয়লা বেশি আনার কোনো সুযোগ নেই। বরং ট্রাকে ১২ মেট্রিক টন কয়লা থাকার কথা থাকলেও প্রায় সময় ২০০ থেকে ৫০০ কেজি কম থাকে। এতে অনেক ক্ষতির মুখে পড়েন ব্যবসায়ীরা। আর আমাদের বন্দরে ওজন মাপার স্কেল না থাকায় কয়লা গ্রহণের সময় ভারতের পাঠানো কাগজের ওপরই ভরসা করতে হয়। ট্রাকে কয়লা যদি ওজনে কম আসার সুযোগ থাকে তাহলে বেশি আসারও তো সুযোগ আছে। এটা হয় কি না? এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি। কড়ইতলি কোল অ্যান্ড কোক ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুরুজ মিয়া বলেন, খুব শিগগির আমাদের দুটি বন্দরেই ওজন স্কেল বসানো হয়ে যাবে। আশা করছি, আগামী জুন-জুলাই মাসেই চলমান উন্নয়নকাজ শেষ হয়ে বন্দর দুটি পুরোপুরি চালু হয়ে যাবে। তখন আর এমন অভিযোগ করার সুযোগ থাকবে না।