রাজধানীর গুলিস্তান থেকে কেনা তামার কয়েন দিয়ে কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে একটি চক্র। অথচ ওই কয়েনগুলোর দাম ৪০-৫০ টাকা। এরপর সেসব কয়েন প্রত্নতাত্ত্বিক দাবি করে বিক্রি করা হতো। কিছু টার্গেট করা ব্যক্তির সঙ্গে কয়েনের দরদাম চলত পাঁচ তারকা হোটেলে। এই ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেকেই।
গত কয়েক দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রের তিন দালাল ও কথিত এক রসায়নবিদকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৪২টি ধাতব মুদ্রা জব্দ করা হয়েছে। এদের দেওয়া তথ্যে ঢাকার সাভারে অভিযান চালিয়ে চক্রের আরেক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এই ব্যক্তির দেওয়া তথ্যে মানিকগঞ্জের একটি বাঁশঝাড় থেকে জব্দ করা হয় ১১ লাখ টাকা। ডিবির গুলশান বিভাগ সূত্র জানায়, এসব কয়েন ক্রেতার সামনে স্কচটেপে মোড়ানো প্যাকেট থেকে খোলা হয়। কার্বন কাগজের আরেকটি প্রলেপ ছিঁড়ে কয়েন বের করে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে পরীক্ষা করেন কথিত রসায়নবিদ। সাজানো পরীক্ষায় সেই রসায়নবিদ চার ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করেন। নিখুঁত পরীক্ষার পর তিনি জানান, এর মধ্যে দুটি কয়েন আসল। ক্রেতা-বিক্রেতা ও দালালের উপস্থিতিতে দুটি কয়েনের দাম নির্ধারণ হয় পাঁচ কোটি টাকা। কথিত ৪০০ বছরের পুরনো দুটি কয়েনের দামে ক্রেতা সন্তুষ্ট হয়ে ৪০ লাখ টাকা অগ্রিম দেন। এরপর বাকি টাকা পরিশোধের তারিখ ঠিক করে নেন বিদায়। নির্দিষ্ট তারিখে বাকি টাকা পরিশোধ ও কয়েন নিতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি। খোঁজ মেলে না সেই দালাল বা বিক্রেতার। এরপর বাধ্য হয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হন ক্রেতা।
প্রতারণার শিকার এই ব্যক্তি জানান, কয়েন বিক্রির কথা বলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তার কাছে বিক্রির কথা বলে স্ট্যাম্প করে ৪০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শত বছরের পুরনো কয়েন দরকার-এমন লোকদের টার্গেট করে চক্রটি। পরে নিজেরাই দালাল ও বিদেশি ক্রেতা সেজে কোনো তারকা হোটেলে বসে দরদাম ঠিক করে। আসলে কয়েনগুলো পুরনো নয়। এগুলো গুলিস্তান থেকে কিনে আনা হয়, যা শুধু তামা দিয়ে তৈরি। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- সাইফুল ইসলাম ওরফে বিষ্ণু মালো ওরফে শঙ্কর মালো ওরফে স্বপন, সাইদুল ইসলাম জিহাদ ওরফে রাজা, সৈয়দ মুস্তাকিন ওরফে অহিদুজ্জামান এবং মতিন মোল্লা ওরফে মোল্ল্যা আতিক। গতকাল এ বিষয়ে ডিবি গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান জানান, সাধারণত তামা দিয়ে এসব কয়েন তৈরি হয়। যাতে লিখে দেওয়া হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নাম। এই কয়েনগুলোকে একদল প্রতারক গুলিস্তান থেকে কিনে নেয়। তারপর চক্রটি বাংলাদেশি সরলমনা, কিন্তু লোভী টাইপের লোকদের বিভিন্ন হোটেলে নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে দেখায় এবং একেকটির দাম হাঁকে ৪-৫ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, প্রায় ১০ বছর ধরে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে কয়েনের পেছনে ছুটে প্রতারিত হয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করা মৌলভীবাজারের সৈয়দ মুস্তাকিন আলী ওরফে ওয়াহিদুজ্জামান নিজেই কয়েন প্রতারণার ব্যবসায় নেমে পড়েন। মতিন মোল্যা ওরফে মোল্যা আতিকের কাছ থেকে একই প্রক্রিয়ায় প্রতারণার কৌশল শেখা সাইদুল ইসলাম জিহাদ ওরফে রাজার সঙ্গে সৈয়দ মুস্তাকিন আলী ওরফে অহীদুজ্জামানের পরিচয় হয়। প্রথমত সাইফুল ইসলাম ওরফে স্বপন কমলাপুর এলাকার রনির মাধ্যমে ভুক্তভোগীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। ভুক্তভোগীর পরিবারের সঙ্গে প্রতারক চক্র প্রথমে তাদের বাসায় এবং পরবর্তীতে একবার রেডিসন হোটেলে, দুইবার লা মেরিডিয়ান হোটেল এবং পরবর্তীতে দুইবার উত্তরার লেকভিউ হোটেলে মিটিং করে প্রতারণার বিভিন্ন ধাপ সম্পন্ন করে। প্রতারক চক্রটি প্রথমত তিনটা গ্রুপে ভাগ হয়ে কার্য সম্পন্ন করে। প্রথম গ্রুপে থাকে মিডিয়াম্যান যার নেতৃত্ব দেয় সাইদুল ইসলাম ওরফে রাজা, দ্বিতীয় গ্রুপে থাকে সাইফুল ইসলাম ওরফে শংকর মালো এবং মতিন মোল্যা ওরফে মোল্যা আতিক। তৃতীয় গ্রুপে থাকে দুজন বিদেশি বায়ার এবং একজন বায়ারের প্রতিনিধি। বিদেশি বায়ার দুজনকে ম্যানেজ করে সৈয়দ মুস্তাকিন আলী ওরফে অহিদুজ্জামান। সিলেটে বাড়ি লন্ডন প্রবাসী আখলাক এবং সাইমন বিদেশি বায়ার সাজে এবং তাদের প্রতিনিধি এবং কেমিস্ট সাজে সৈয়দ মুস্তাকিন আলী ওরফে অহিদুজ্জামান।