শনিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

সড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ

মহাসড়কে মোটরসাইকেল, থ্রি-হুইলার বৃদ্ধিতে দুর্ঘটনা ঘটছে

জিন্নাতুন নূর

দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো ক্রমেই মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠছে। ঘর থেকে কেউ বেরিয়ে সড়কে নামলে সুস্থভাবে গন্তব্যে পৌঁছাতে বা বাড়ি ফিরতে পারবেন কি না উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হয়। আর এমনটি হচ্ছে অনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনার কারণে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে। পথচারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ প্রণয়নের পরও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের তালিকায় সংখ্যা কমছে না। মহামারিকালে সড়ক দুর্ঘটনা কম হওয়ার কথা, কিন্তু উল্টো এ সময় বেশি ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কের নিরাপত্তার জন্য আমরা অর্থ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী না। আবার মহাসড়কগুলোতে দূরপাল্লার বাহন হিসেবে এখন মোটরসাইকেল এবং থ্রি-হুইলারের মতো যান চলাচল বৃদ্ধির কারণে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি বাড়ছে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর পরিসংখ্যানে বলা হয়, ২০২১ সালে সারা দেশে সড়কপথে ৩ হাজার ৭৯৩টি দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ২৮৯ জন নিহত এবং ৫ হাজার ৪২৪ জন আহত হন। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটেছে। মহামারির কারণে এ বছরে অফিস-আদালত, দোকানপাট বন্ধ ছিল এবং লকডাউনে গণপরিবহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকার পরও এ বছর দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।

প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনার বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়। যেমন- সড়কের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং মনিটরিংয়ের অভাব, টাস্কফোর্সের ১১১টি সুপারিশনামা বাস্তবায়ন না হওয়া, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা, দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো, লাইন্সেস ছাড়া চালক নিয়োগ, পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব,  ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ওভারটেকিং করা, বিরতি ছাড়া দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো বন্ধে আইনের প্রয়োগ না থাকা, সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি বৃদ্ধি, মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, একই রাস্তায় বৈধ ও অবৈধ এবং দ্রুত ও শ্লথ যানবাহন  চলাচল, রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাট থাকা।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন  থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ২০২১ সালে ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন নিহত এবং ৯ হাজার ৩৯ জন আহত হন। ২০২০ সালের  তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে ৩০ দশমিক ৪২ শতাংশ ট্রাক, পিকআপ, লরি ও কাভার্ড ভ্যান; ২৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ মোটরসাইকেল; ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ বাস; ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ নসিমন-করিমন-ট্রাক্টর ও লেগুনা; ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা; ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক এবং ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ২০২১ সালে পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনা, ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা বেড়েছে। এ বছর দুর্ঘটনার ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে এবং ৩৯ দশমিক ২৯ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে হয়।

সম্প্রতি কক্সবাজারের চকরিয়ায় বাবার শ্রাদ্ধের আয়োজন করতে গিয়ে একসঙ্গে পাঁচ ভাইয়ের প্রাণ গেছে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায়। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তারা সড়কের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় একটি পিকআপ তাদের চাপা দিয়ে চলে যায়। এর মধ্যেই গত ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির হাইদচকিয়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির দুই ছাত্রীর মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। ট্রাফিক পুলিশের তাড়া খেয়ে ধানবাহী চাঁদের গাড়ি উল্টে এই দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এর আগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে বাসের ধাক্কায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার তিন যাত্রী নিহত এবং আরও দুজন আহত হন। তারা সবাই একই পরিবারের সদস্য। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী, যানবাহনের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার পাশের দেশ ভারতের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে বাংলাদেশে বছরে মৃত্যু হয় ৪৫টি। আর ভারতে এই হার ১০.২টি। এই হিসাবে অবশ্য অনিবন্ধিত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার তথ্য ধরা হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মহামারিতে গণপরিবহন তুলনামূলক কম চলাচল করলেও এ সময় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি হয়। কারণ তখন গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে সবাই মোটরসাইকেলকে বেছে নিয়েছিল। আবার ভারী যানবাহন চলাচলও এ সময় বন্ধ হয়নি। ফলে মহামারির মধ্যেও সড়ক দুর্ঘটনার হার না কমে বরং বাড়ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা নিরাপদ সড়ক চাই। কিন্তু সড়কের নিরাপত্তার জন্য আমরা অর্থ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী না। বাজেটে এমন কোনো খাত নেই যে খাত থেকে সড়ক নিরাপত্তার জন্য খরচ করা হবে। সড়ক পরিবহন  ও সেতু মন্ত্রণালয়েও গবেষণামূলক কোনো সেল নেই। সড়ক নিরাপত্তায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। প্রয়োজন অর্থনৈতিক উদ্যোগ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার। আমরা দীর্ঘদিন ধরে ট্রাফিক ব্যবস্থাকে সিসিটিভি ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণে আনার কথা বলে আসছি। এতে অপরাধ কে করছে তা চিহ্নিত করা সম্ভব। কারণ অপরাধী শনাক্ত না হলে এবং তার যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত না হলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে না। আবার সড়ক দুর্ঘটনায় সবসময়ই চালককে বলির পাঁঠা বানাই। কিন্তু সড়কে সব রকম বিশৃঙ্খলা বজায় রেখে চালককে একা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা ঠিক না। আমরা সড়ক দুর্ঘটনায় যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তা মলম লাগিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করছি। কিন্তু মূল জায়গাতে কেউ হাত দিচ্ছি না।  বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, একটি বিষয় স্পষ্ট যে, মোটরসাইকেলের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার প্রাইভেট কারের তুলনায় অটোরিকশা, ইজিবাইক ও থ্রি-হুইলারের দুর্ঘটনার তিন গুণ বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা যেভাবে ঘটছে তা যদি চলতেই থাকে তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জিত হবে না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মোটরসাইকেলের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভারী যানবাহনের মধ্যে সম্প্রতি ট্রাক দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার গত এক বছরে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যাও বেড়েছে। এ থেকে সড়কে নৈরাজ্য বাড়বে। আর নৈরাজ্য বাড়লে সড়ক দুর্ঘটনাও বাড়বে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর