শুক্রবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

রেকর্ড উৎপাদনেও হুমকিতে চা-শিল্প

সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি বাগান মালিকরা

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

রেকর্ড উৎপাদনেও হুমকিতে চা-শিল্প

দিন দিন দেশে বেড়েই চলছে চায়ের উৎপাদন। ১৬৮ বছরের বাণিজ্যিক উৎপাদনের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে গেল বছর। কিন্তু রেকর্ড উৎপাদনেও কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। উৎপাদনের সঙ্গে খরচ বাড়লেও নিলামে বাড়ছে না চায়ের দাম। ২০ বছর আগে নিলামে যে দামে চা বিক্রি করতেন বাগান মালিকরা এখন সেই দামও পাচ্ছেন না তারা। সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ায় চায়ের ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বাগান মালিকরা। এ ছাড়া চোরাইপথে ভারত থেকে নিম্নমানের চা আসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশীয় চায়ে। বছরের পর বছর লোকসান গোনায় এখন অনেক বাগান মালিককে ঋণ দিতেও চাচ্ছে না ব্যাংক। এ অবস্থায় অনেক মালিক বাগান বিক্রি করে দেওয়ারও পরিকল্পনা করছেন বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্র জানায়, ২০২১ সালে দেশে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ কোটি  কেজি। বছর শেষে দেশের সব কটি বাগান থেকে উৎপাদিত চায়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৬ হাজার কেজি। যা ১৬৮ বছরের ইতিহাসে বাণিজ্যিক চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড ছিল। আগের বছরের চেয়ে ২০২১ সালে ১ কোটি ১১ লাখ কেজি বেশি চা উৎপাদন হয়। এর আগে ২০১৯ সালে উৎপাদিত হয়েছিল ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি। যা ছিল সে সময় পর্যন্ত উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড। চা বাগান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চায়ের রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদনও কোনো সুখবর দিতে পারছে না বাগান মালিকদের। দিন দিন উৎপাদন খরচ বাড়লেও নিলামে বাড়ছে না চায়ের দাম। ২০ বছর আগেও যেখানে নিলামে প্রতি কেজি ‘ব্ল্যাক টি’ বিক্রি হয়েছে ২৩০-২৪০ টাকা দরে। সেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিক্রি হয়েছে ১৯৩ টাকা দরে। এর মধ্যে উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। সূত্র জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ৪০টি নিলামে (বছরে মোট ৪৫টি নিলাম অনুষ্ঠিত হয়) ৮ কোটি ৩৭ লাখ ৯৫ হাজার কেজি চা গড়ে ১৯৩.৬৩ টাকা বিক্রি হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি। এখনো অবিক্রীত রয়ে গেছে ১ কোটি ২৭ লাখ ৫ হাজার কেজি। চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট ৫টি নিলামে এই বিপুল সংখ্যক চা বিক্রি প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ‘বায়ার সিন্ডিকেট’র কারণে এক দিনে মিলছে না উপযুক্ত দাম, অন্যদিকে চা রয়ে যাচ্ছে অবিক্রীত এমন অভিযোগ সাধারণ বাগান মালিকদের। বাগান মালিকরা জানান, চলতি অর্থবছরে গড়ে প্রতি কেজি চা ১৯৩.৬৩ টাকা দামে বিক্রি হলেও উৎপাদন খরচ পড়েছে ২৫১ টাকা। অর্থাৎ প্রতি  কেজি চায়ে বাগান মালিকদের লোকসান গুনতে হয়েছে ৫৭.৩৭ টাকা।

এর আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) ৪০টি নিলাম পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল ৮ কোটি ৩ লাখ ৮৬ হাজার কেজি চা। ওই সময় চায়ের উৎপাদন ছিল ৮ কোটি ৬৬ লাখ কেজি। অর্থাৎ ৪০টি নিলাম পর্যন্ত অবিক্রীত চায়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ৬২ লাখ ১৪ হাজার কেজি। যা চলতি অর্থবছরের প্রায় অর্ধেক। বাগান মালিকরা জানান, নিলামে চায়ের দাম কমলেও দিন দিন বাজারে প্যাকেটজাত চায়ের মূল্য বাড়ছে। নিলামে চায়ের দাম কমার পেছনে চা প্যাকেটজাত করে যেসব কোম্পানি বিক্রি করছে সেসব কোম্পানির একটি সিন্ডিকেটকেই দায়ী করছেন তারা। বাগান মালিকদের অনেকেরই অভিযোগ, চা বিপণনকারী কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে কম মূল্যে চা বিক্রি করতে বাধ্য করছে। যেহেতু বাগান মালিকদের তাদের উৎপাদিত চা নিলাম ছাড়া বিক্রির সুযোগ নেই তাই তারাও সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে কম মূল্যে চা বিক্রি করছেন। এসব বিপণন কোম্পানির অনেকের আবার নিজস্ব চা বাগানও রয়েছে। তারা নিজেদের চা কম মূল্যে নিজেরা কিনে নিয়ে চড়া দামে প্যাকেটজাত করে বিক্রি করছে। ফলে তারা ঠিকই চা থেকে লাভ তুলে নিচ্ছে। এদিকে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে আসছে নিম্নমানের চা। এসব চায়ে বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ায় দেশীয় চায়ের কদর কমছে। বর্তমানে উৎপাদিত চায়ের মাত্র ৩ শতাংশ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাকি ৯৭ ভাগ চা দেশে থেকে যাচ্ছে। কিন্তু ভারতীয় চায়ের কারণে দেশীয় চায়ের চাহিদা কমছে। জানা গেছে, গেল কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে লোকসানের কারণে এখন ব্যাংক থেকেও ঋণ পাচ্ছেন না অনেক বাগান মালিক। টানা ২-৩ বছর যেসব বাগান লোকসান দিয়েছে সেসব বাগান মালিককে ঋণ দেওয়া থেকে বিরত রয়েছে রাষ্ট্রায়াত্ত কৃষি ব্যাংক। ফলে মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়তে হচ্ছে তাকে। এ অবস্থায় অনেক বাগান মালিক বাগান বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বুরজান চা বাগানের মহাব্যবস্থাপক আবদুস সবুর খান জানান, চা-শিল্প এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। এ শিল্পের ভবিষ্যৎ এখন পুরোপুরি অন্ধকারে। উৎপাদন ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যদি চায়ের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয় তবে হয়তো বাগান মালিকরা কোনোভাবে ঠিকে থাকতে পারবেন। তিনি বলেন, প্রতিবছর গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল, শ্রমিকের মজুরি ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাড়ছে। বিপরীতে কমছে চায়ের দাম। এই বৈপরীত্য অবস্থায় কোনো বাণিজ্যিক খাত টিকে থাকতে পারে না। এ ব্যাপারে সরকার যত দ্রুত উদ্যোগ নেবে ততই চা-শিল্পের মঙ্গল হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর