শুক্রবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
আত্মহত্যা

ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সাবেক রাবি শিক্ষার্থীর চিরবিদায়

রাবি প্রতিনিধি

হতাশায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিষ পান করে আত্মহত্যা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইশতিয়াক মাহমুদ পাঠান নামের এক সাবেক শিক্ষার্থী। গতকাল ভোরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে তিনি এই আত্মহননের পথ বেছে নেন বলে জানিয়েছেন তার চাচাতো ভাই রুশো।

রুশো আরও জানান, আত্মহননকারী ইশতিয়াক মাহমুদ পাঠানের বাড়ি যশোরের আর এন রোডে। পিতা মৃত সৈয়দ আলী পাঠান ও মাতা সৈয়দা আমেনা বেগম। ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১০-১১ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন।

আত্মহত্যার আগে আবেগঘন এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে মৃত্যুর কারণ বর্ণনা করেছেন ইশতিয়াক মাহমুদ।  স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন-

‘লেখাটা যখন আপনারা পড়বেন, তখন আমি আপনাদের ছেড়ে অনেক দূরের, না ফেরার দেশের যাত্রী। আমি জানি, আপনাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা আমাকে ভালোবাসেন। হয়তো কোনো কারণ ছাড়াই বাসতেন। খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলাম না হয়তো কারও কাছে। তবে ছিলাম তো? আবার অনেকেই আছেন যারা আমাকে ঘৃণা করতেন। কেন করতেন??! আপনাদের মধ্যেই কেউ একজন আমাকে মাথায় তুলে আবার ছুড়ে ফেলেও দিয়েছেন। তাতেও আমার কারও বিরুদ্ধে আর কোনোই অভিযোগ নেই। আমার সমস্যা শুধু আমার নিজেকে নিয়ে। নিজের মনটাকে আর বুঝিয়ে রাখতে পারছিলাম না। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমি বারবার হেরে যাচ্ছিলাম। রোজই মৃত্যু আমাকে তাড়া করছিল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না; সেই কবে থেকে। গত কিছুদিন আমি অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করেও বাঁচতে চেয়েছি। ভরপুর বেঁচে থাকার সাধ ছিল। সম্ভাব্য সব মানুষের কাছে বেঁচে থাকার আর্জি জানিয়েছি। আমি বারবার বাঁচতে চেয়েছিলাম। আমি সব সময় একজন সাহিত্যিক হতে চেয়েছিলাম। লর্ড বায়রন, দস্তয়েভস্কির মতো অসাধারণ গল্প, উপন্যাস লিখে পাঠকদের মুগ্ধ করে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুধু এই ভয়ংকর লেখাটাই লিখতে পারলাম। আমি সাহিত্য, ছোট গল্প আর কবিতা ভালোবাসতাম। এরপর একদিন?! একদিন আমি একটা মানুষকেও ভালোবেসে ফেললাম! কিন্তু সেদিন বুঝিনি মানুষকে ভালোবাসা সবচেয়ে বড় পাপ। শুধু মানুষই ভালোবাসার বদলে ঘৃণা দেয়।

মানুষকে ভালোবাসার কারণে পৃথিবীতে মানুষ যে পরিমাণ শাস্তিভোগ করেছে আর কিছুতে তার অর্ধেকও করেনি। ভালোবেসে কাছে আসার অপরাধে মানুষকে জীবন দিয়ে তার মূল্য দিতে হয়। বুঝিনি সেই মানুষটার অনুভূতিগুলো মিথ্যার ছিল। প্রেমকে পাপ বানিয়ে ফেলা তার কাছে যৌক্তিক। কত সহজে সব পিষে দূরে ছুড়ে ফেলল। তার বিশ্বাসের রংও কালো ধোঁয়ায় মোড়ানো ছিল। আমার নিজস্বতা আমি তার মধ্যে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেখান থেকে আর ফিরে আসতে পারিনি। আমি পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেলাম। দিনের পর দিন সে আমাকে নিঃস্ব হতে সাহায্য করেছে। এসব কিছুই বুঝিনি আমি। শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হলো আমি কত বোকা! যখন বুঝলাম; তখন দেখলাম দুঃখ পেয়েও ভালোবাসা পাওয়া সত্যিই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন মানুষের সঙ্গে অন্য একজন মানুষ কত সহজে কি নিষ্ঠুরতা করতে পারে। একটি বিশ্বাস, একটু ভালোবাসা, এমনই সস্তা কোনো জিনিস যে তার প্রতি এত বেশি অবহেলা?

আচ্ছা! মানুষের সঙ্গে মানুষের আচরণ এমন হবে কেন? মানুষ নাকি সৃষ্টির সেরা জীব! কখনও কোনো মানুষকে পরিপূর্ণ ভালোবাসা ঠিক নয়। তাহলে নিজের জন্য আর একটুও ভালোবাসা অবশিষ্ট থাকে না। পরিপূর্ণভাবে কাউকে ভালোবাসলে পরিপূর্ণ নিঃস্ব হয়ে যেতে হয়। ছোটবেলা থেকেই একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য লালায়িত ছিলাম। তাই হয়তো আকাতরে অপাত্রে ভালোবাসা দিয়ে গেছি। বিনিময়ে শুধু ঘৃণা পেয়েছি। ভালোবাসা যে কি তা শুধু কাউকে পরম ভালোবাসলেই বোঝা যায়।

প্রথমবার এই চিঠি লিখছি। এবং শেষবারও। আমায় ক্ষমা করবেন, আমার কথার যদি অর্থ না বোঝেন? তাহলে ধরে নেবেন একটা পাগল-ছাগল লোকের কথা এমনই হয়। আমার জন্ম একটা দুর্ঘটনার মতো। শৈশবের একাকিত্বের অভাব আমি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। হতে পারে পৃথিবী আমার জন্য কঠিন ছিল। আমি বুঝতে পারছি আমি ভুল করেছি। সব সময়, সব কিছু পুরোটাই। ভালোবাসা, ঘৃণা, যন্ত্রণা, জীবন, মৃত্যু- সব কিছুই বুঝতে হয়তো আমার ভুল হয়েছে। না! আমার বোঝার কোনো তাড়া ছিল না। আসলেই ছিল না। কিন্তু আমাকে সবসময় যন্ত্রণার কাঁটাতারের ওপর হাঁটতে হয়েছে। একটা জীবন এত যন্ত্রণার কেন?! সেই সব মানুষ, যারা আপন মানুষের বেশ ধরে কাছে এসে বুকে হাত রাখে। তারপর চলে যাওয়ার সময় হৃৎপি-টা ছিঁড়ে নিয়ে যায়। অন্যের জীবন যাদের কাছে এত মূল্যহীন তারা ভালো থাকে কী করে??  না, আমি কষ্টে নেই এখন। আমার কোনো দুঃখ বোধও নেই। কোনো যন্ত্রণা নেই। আমি শূন্য। সব দুঃখ, কষ্টের অবসান হতে চলেছে। চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমেছে। একটু পরই ঘুমিয়ে যাব। একেবারে চিরকালের মতো। অতল থেকে অতলান্তে। নিজেকে নিয়ে আমি চিন্তিত নই। যা পেয়েছি আমি জানি তা কত ভয়ংকর। আর সে জন্যই আমি আজ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মানুষ হয়তো আমাকে বোকা বলবে, আমাকে ভীতু বলবে। আবার স্বার্থপরও বলবে। অথবা বলবে আমি গাধা। কিন্তু আমাকে কে কি বলবে, না বলবে তাতে এখন আর আমার কিছু আসে যাবে না।

আমি মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, আত্মার ঝুলে থাকা, আত্মার আফসোস নিয়ে ভেসে বেড়ানো; এসব কিছু নিয়ে ভাবছি না। সত্যিই যদি পরকাল বলে কিছু থাকে, তাহলে নিশ্চিত একদিন আমি হাবিয়া দোজখে যাব। আর তা এই সময়ের চেয়ে হয়তো কঠিন হবে না। জীবন কঠিন যন্ত্রণা আর অবহেলার। মৃত্যু সেই সব থেকে মুক্তি দেয়। জীবনের চেয়ে মৃত্যু সহজ।

মামনি যেদিন সবার সামনে চড়, থাপ্পড় দিয়েছিল... ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বলেছিল বাসা থেকে বের হয়ে যাহ!... গলা ধাক্কা খাবার মতো কোনো অপরাধ কি আমি সত্যিই করেছিলাম! সেদিন আমার অপরাধ কতটুকু ছিল?! তারপর আমার কেবলই মনে হতো সবার নিজের একটা বাড়ি থাকা আবশ্যক। একেবারে নিজের বাড়ি। যেখান থেকে কেউ তাকে বের করে দেবে না। আমার সেই নিজের বাড়ি আমি পেয়ে যাব আজ...

তোমাকে দোষ দিব না। দিতে চাইও না। তোমার কোনো অন্যায় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি তুমি দুঃখিত হওয়ার চেয়ে রাগান্বিত হয়েছ বেশি। তুমি তোমার ভুলটা বুঝতে পারনি; বরং আমাকে ভুল বুঝেছ। যে কোনো সম্পর্কের মধ্যে শুধু কমিটমেন্ট থাকলে হয় না, সেই কমিটমেন্ট রাখারও কমিটমেন্ট থাকতে হয়। ভালোবাসার মধ্যে শীতলতা থাকতে হয়। আপনজনের সঙ্গে তরল কণ্ঠে কথা বলতে হয়। রাগ, অভিমান এগুলো সব সম্পর্কের মধ্যেই থাকে। তোমাকে হয়তো আমার ভালোবাসাটা বোঝাতে পারিনি। তোমাকে ভালোবেসে আমি সব ছেড়েছিলাম। সবাই কেই। তার বিনিময়ে?! তুমি আমাকে ছেড়েছ। আজ আমার কেউ নেই। কিছু নেই। সব হারিয়ে যাকে পেতে চেয়েছিলাম সেও হারিয়ে গেল। পুরোপুরি নিঃস্ব যাকে বলে। আমার ভুল কী ছিল? আমার অপরাধটা কী?? মানুষ হিসেবে কি আমার জানার অধিকার নেই? আমার ভুল কী ছিল?? আমার অপরাধ কী??? আমাকে ভুলে যেতে বলেছ?... তোমার মনে আছে?! প্রথম যেদিন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়... তোমার মায়া মুখ আর অভিমানে বাঁকানো ঠোঁট। আমার হাত ধরে কি মায়া মায়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে! আমি কি-যে মুগ্ধ হয়েছিলাম... তখনই তোমার সুবাস আমার ফুসফুসে আটকে গেছে। তোমাকে ভুলে যাব কি করে বল? নিঃশ্বাস নেওয়া যেদিন ভুলে যাব সেদিন তোমাকে ভুলতে পারব। আর তাই তো সব অভিমান বুকে চেপে নীরবে চলে গেলাম চিরদিনের মতো। তুমি কখনো মনে কর না... আমাকে। আমার সঙ্গে কি কি করেছ সেই সব কিছুও। মনে করলে তুমি শিউরে উঠবে। তোমার রাতের ঘুম চলে যাবে। অপরাধ বোধ তোমাকে ‘ছুড়ে-খুঁড়ে’ খাবে। তোমার সব আনন্দ বিস্বাদে পরিণত হবে। শেষ দিকে কি অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছ তুমি আমাকে; মনে আছে? আমি নিতে পারছিলাম না দেখার পর তুমি আরও বেশি নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছ। আহারে কষ্ট। আহারে কষ্ট। কি অসহ্য যন্ত্রণা। অপমান, অবহেলা আর লজ্জার সব স্তর পার করে তবেই নাকি ঘৃণার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়াতে হয়। আমি সেখানে দাঁড়িয়েও বাঁচতে চেয়েছিলাম... একটা কুকুরের বাচ্চাও তো ব্যথা পেলে শব্দ করে ওঠে। আমি তো মানুষ!

আমার এই লেখাটা যে বা যারা পড়ছেন, সবার কাছে আমার একটা অনুরোধ। দয়া করে আমার হয়ে কয়েকটি কাজ করে দেবেন। ই-কমার্স খাতের ‘থলে.কম’ (ঞযড়ষধু.পড়স) নামে একটা কোম্পানির কাছে আমার মোট ৪৭ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ টাকা বিনিয়োগ করা আছে। (আমার ড্রয়ারে চেক আর ডকুমেন্টস রাখা আছে) আমার নিজের টাকা। দয়া করে দেখবেন, সেই টাকাটা তুলে আমার ভাইবোনদের দেবেন। ওদের কখনো কিছু দিতে পারিনি। সব সময় নিয়ে গেছি। আমার একটা মোটর মেকানিক বন্ধু আছে; জাকির। ও আমার কাছে ৫০ হাজার টাকা পাবে। ধার নিয়েছিলাম। ৪ মাস আগে। কোনো দিন ফেরত চায় নাই। দয়া করে ওর টাকাগুলো পরিশোধ করে দেবেন। আমার কাফন, দাফন যেন স্বাভাবিক ও সুস্থ হয় তা দেখবেন। জানবেন, আমি বেঁচে থাকার চেয়ে মরে শান্তি পেয়েছি। বাবার কবরের পাশের জায়গাটায় আমাকে সমাহিত করবেন।

আত্মহত্যা করা মানুষের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কাজে লাগে কি না আমার জানা নেই। যদি সম্ভব হয়; আমার চোখ দুটো কাউকে দান করবেন। এই চোখে আমি কিছু কঠিন মুখ দেখেছি। মৃত্যুর পরের জীবনে অন্ধ থাকতে চাই। ছাদের চিলেকোঠায় আমার ঘরটার বইয়ের সেলফে আমার লেখা যত পা-ুলিপি আছে সব পুড়িয়ে ফেলবেন।

পরিবারের সবার কাছে ক্ষমা চাইছি; সবাইকে নিরাশ করার জন্য। সবাই বড্ড ভালোবেসেছিলে আমায়। সেই ভালোবাসার কোনো দাম দিতে পারিনি। ভবিষ্যতের জন্য আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। ভালো থাকবেন সবাই। আমি আসল ব্যাপারটাই লিখতে ভুলে গেছি। নিয়ম মাফিক কথাটা লিখতে।

আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। কেউ তার কথায় বা কাজে কিংবা অন্য কোনোভাবে আমাকে আত্মহননের জন্য প্ররোচিত করেনি। এটা আমার একান্ত নিজের সিদ্ধান্ত এবং শুধু আমিই এই কাজের জন্য দায়ী। এর জন্য কাউকে যেন আমার শত্রু বানানো না হয়। আমার কোনো শত্রু ছিল না! বন্ধুও না!! কাউকে আমার মৃত্যুর পর দোষী বানাবেন না। ভালো থেক... ‘ভালোবাসা’রা।’

সর্বশেষ খবর