শুক্রবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

বিচার কাজ শেষ হয়নি ১৩ বছরেও

আরাফাত মুন্না

বিচার কাজ শেষ হয়নি ১৩ বছরেও

আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি। পিলখানায় বিডিআর (বিজিবি) বিদ্রোহের ১৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ২০০৯ সালের এই দিনে হঠাৎ গুলি ও বোমার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে রাজধানী। সেদিন পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরকে রক্তাক্ত করে বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য। হত্যা করা হয় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে। টানা দুই দিনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। পিলখানা বিদ্রোহের পর বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি করা হয়। পরিবর্তন করা হয় বাহিনীর লোগো এবং পতাকা।

এ ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলার বিচার দুটি ধাপ পার করেছে। বিচারিক আদালত ও হাই কোর্ট হয়ে আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে এ মামলা। তবে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলার বিচার চলছে ঢিমেতালে। ঘটনার ১৩ বছর পার হলেও এখনো নিম্ন আদালতই পেরোতে পারেনি মামলাটি। ১২৬৪ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত শেষে হয়েছে মাত্র ২১০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ। দুটি মামলার বিচারে ধীরগতির জন্য মহামারি করোনাভাইরাসকে দায়ী করছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রুব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করেন তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক নবজ্যোতি খিসা। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর করা হয়। এরপর ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর পুরান ঢাকার বকশীবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত রায়ে বিডিআরের সাবেক ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদন্ড এবং বিএনপির সাবেক এমপি নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু (প্রয়াত), স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়। রায়ে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭৭ জনকে খালাস দেয় বিচারিক আদালত। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১৫২ আসামির মধ্যে ১৪ জন পলাতক। এ ছাড়া বন্দি অবস্থায় তোরাব আলীসহ দুই আসামি মারা গেছেন। ২০১৩ সালের নভেম্বরের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাই কোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯ আসামির মৃত্যুদন্ডের আদেশ বহাল রাখে। এ রায়ে ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১৯৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় হাই কোর্ট। খালাস পান ৪৯ আসামি। দুই বছরের বেশি সময় পর গত বছর ৮ জানুয়ারি ১১ দফা পর্যবেক্ষণসহ হাই কোর্টের ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় (ডেথ রেফারেন্স ও আপিল) প্রকাশিত হয়। বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চের বিচারপতিরা বাংলা ও ইংরেজিতে দেওয়া রায়ে ভিন্ন পর্যবেক্ষণ দেন। রায়ে মামলার প্রেক্ষাপট, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা ও নৃশংসতার চিত্রও তুলে ধরা হয়। এরপর এ পর্যন্ত এ মামলায় ২০৩ আসামির পক্ষে ৪৮টি আপিল আবেদন সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় দাখিল করা হয়েছে।

এদিকে হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় দুটি ধাপ শেষ হলেও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলাটি এখনো বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। এ মামলায় ১ হাজার ২৬৪ জনের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ২১০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ৮ মার্চ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে এ মামলার বিচার চলছে।

হত্যা মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনার কারণে এ মামলাটির আপিল শুনানিতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তিনি বলেন, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১৩৯ জন আপিল করেছেন। এ ছাড়া যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্তরাও আপিল করেছেন। কিছু আসামির মৃতুদন্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করে দিয়েছেন হাই কোর্ট। এ বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে আমরাও আপিল করেছি। সবগুলো একসঙ্গেই শুনানি হবে।

 আশা করছি চলতি বছরেই এ আপিল শুনানি শুরু হবে। আসামিদের সাজা বহালে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন বলেও জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।

হত্যা মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে আসামি পক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হাই কোর্টের রায়ের পর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের পক্ষে সরাসরি আপিল এবং অন্যান্য সাজাপ্রাপ্ত আসামির পক্ষে লিভ টু আপিল দাখিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই মামলাটি আসামির সংখ্যা ও মৃত্যুদন্ড বিবেচনায় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা। এ ধরনের মামলায় বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে শুনানি হওয়া জরুরি। তাই প্রধান বিচারপতি মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেই আশা করি।

বিস্ফোরক মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঘটনাস্থল, সাক্ষী ও আসামি একই হওয়ায় দুটি মামলায় একসঙ্গে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। তবে আসামিপক্ষের আবেদনে মামলা দুটির বিচারকাজ পৃথকভাবে চলে। তিনি বলেন, মামলাটিতে এ পর্যন্ত ২১০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণেই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছে। তবে চলতি বছরই মামলার বিচারকাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী।

ফিরে দেখা : ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর দরবার হলে ৯৭ সেনা কর্মকর্তাসহ আড়াই হাজারের বেশি সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ওই দিন সকালে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের পর বক্তব্য দেন তখনকার বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহম্মেদ। তার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে হঠাৎ একটি শব্দ হয়। এরপর সেখানে একে একে হত্যা করা হয় ডিজি শাকিল আহম্মেদসহ অনেক সেনা কর্মকর্তাকে। দুই দিন ধরে চলে বিপথগামী বিডিআর সদস্যদের তান্ডব। পরে সরকারের আহ্বানে তারা আত্মসমর্পণ করেন। কেউ কেউ গোপনে পালিয়ে যান। পালিয়ে যাওয়াদের মধ্যেও কেউ কেউ পরে আত্মসমর্পণ করেন। পিলখানা ট্র্যাজেডিতে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন।

বিচার হয়েছে নিজস্ব আইনেও : বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় এ বাহিনীর নিজস্ব আইনেও বিচার হয়। বিডিআর জওয়ানদের ওই রক্তাক্ত বিদ্রোহের পর ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে। এতে মোট ১১ হাজার ২৬৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তার মধ্যে ১০ হাজার ৯৭৩ জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হয়। সাজাপ্রাপ্তের মধ্যে ৮ হাজার ৭৫৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বাকিরা প্রশাসনিক দন্ড শেষে আবার চাকরিতে যোগদান করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষ আদালত গঠন করে ৬ হাজার ৪৬ জওয়ানকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এসব মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড হয়। তাদের প্রত্যেককে চাকরিচ্যুত করা হয়। আর বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত ১১৫ জন পরে চাকরি ফিরে পান।

কর্মসূচি : পিলখানা হত্যাকান্ডে নিহতদের স্মরণে আজ শাহাদাতবার্ষিকী পালন করবে বিজিবি। দিনের কর্মসূচিতে রয়েছে, পিলখানাসহ বিজিবির সব রিজিয়ন, সেক্টর, প্রতিষ্ঠান ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় বাদ ফজর খতমে কোরআন, বিজিবির সব মসজিদে এবং বিওপি পর্যায়ে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় সকাল ৯টায় বনানীর সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক (একসঙ্গে) শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এ ছাড়া শোকাবহ দিবসটি পালন উপলক্ষে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সব স্থাপনায় বাহিনীর পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং বিজিবির সব সদস্য কালো ব্যাজ পরিধান করবেন। আজ বাদ জুমা পিলখানায় বিজিবি কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঢাকা সেক্টর মসজিদ এবং বর্ডার গার্ড হাসপাতাল মসজিদে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর