সোমবার, ২১ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

হঠাৎ বেড়েছে ব্যয়, চিন্তায় সরকার

চাপ বাড়াচ্ছে জ্বালানি ও সারে ভর্তুকি

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সরকারের অপ্রত্যাশিত ব্যয় হঠাৎ বেড়ে গেছে। জ্বালানি ও সারের বিপরীতে ভর্তুকি বেড়ে যাওয়াই সরকারের খরচ বাড়ার মূল কারণ। পাশাপাশি খাদ্য আমদানি ও সাশ্রয়ীমূল্যে নিম্ন আয়ের পরিবারে খাদ্য বিতরণের উদ্যোগ নেওয়ার কারণেও সরকারের ব্যয় বাড়ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সামগ্রিক পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে, যে এটি বাজেটের শৃঙ্খলা নষ্ট করে দিচ্ছে।

অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৪৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে এ ভর্তুকি সরকারের প্রাক্কলনের চেয়ে অনেক বেশি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি অর্থবছর জ্বালানি, সার ও এলএনজি বাবদ সরকারের ভর্তুকি ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ভর্তুকির টাকা চেয়ে অর্থ বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ভর্তুকিতে সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করছে জ্বালানি ও সার আমদানিজনিত বাড়তি ব্যয়। অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে এ ধরনের ব্যয় বৃদ্ধির জন্য সরকার প্রস্তুত ছিল না। এটি পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত ব্যয়। সরকারের যে বাজেট পরিকল্পনা, সেখানে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ফারাকটা বড় হচ্ছে- এটিই চিন্তার বিষয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অপরদিকে গত বছরের তুলনায় সারের দাম বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। কৃষককে সহায়তা দিতে সারের দাম সহনীয় রাখা হচ্ছে। ফলে এখানেও বাড়ছে সরকারের ব্যয়। এ ছাড়া নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে সারা দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির মাধ্যমে ১ কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ খাতেও ব্যয় বাড়ছে সরকারের। চাপ বাড়াচ্ছে জ্বালানি তেল ও সার : জ্বালানি ভর্তুকি বাবদ সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি বেশি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়ায় বিপিসির প্রতিদিন ৮০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে আরও প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ভর্তুকি চেয়ে অর্থ বিভাগে তাগিদ পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

ভর্তুকির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বাড়তি টাকা চেয়ে চিঠি গেছে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকেও। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে যেখানে ৭ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা ভর্তুকি লেগেছে, সেখানে চলতি অর্থবছরে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের পরও অতিরিক্ত ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শুধু সারবাবদ সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। মন্ত্রণালয়ের নীতি নির্ধারকরা বলছেন, দেশের বেশির ভাগ সার আসে রাশিয়া ও ইউক্রেনের পার্শ্ববর্তী দেশ বেলারুশ থেকে। যুদ্ধের কারণে ওই দেশটি থেকে সার আমদানি বন্ধ রয়েছে। কৃষকের উৎপাদন ধরে রাখতে বেশি দামে ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। সারের দাম ও ভর্তুকি বিষয়ক এক সংবাদ সম্মেলনে সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি কোথা থেকে আসবে এ বিষয়ে সরকার গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। এত ভর্তুকি দিলে অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকা  ব্যাহত হবে, অন্যদিকে সারের দাম বাড়ালে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়বে। খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং খাদ্যের দামও বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপম্যান্টের নির্বাহী পরিচালক এম কে মুজেরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও সারের দাম সামাল দিতে হচ্ছে তাই নয়, খাদ্যশস্য আমদানিতেও সরকারের ব্যয় বেড়েছে। এটি একটি অপ্রত্যাশিত ব্যয়। বাজেট করার সময় এ যুদ্ধ পরিস্থিতির বিষয়টি সরকারের চিন্তায় ছিল না। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাধারণ উন্নয়ন খাতের ব্যয় কমিয়ে অনুন্নয়ন ব্যয় সামাল দেওয়া হয়। সেটি করতে গেলে আবার জিপিডি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এখন সরকারের ভর্তুকি ব্যয় এমনভাবে সমন্বয় করতে হবে, যাতে কৃষক ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে এর সুবিধা পুরোপুরি পৌঁছে। তাহলেই এ বাড়তি ব্যয় থেকে সুফল মিলতে পারে।

সর্বশেষ খবর