বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

ভ্যাট আইন সংশোধন চান ব্যবসায়ীরা

সব শিল্প খাতে উৎসে ও আগাম কর বাতিল চায় এফবিসিসিআই

বিশেষ প্রতিনিধি

ভ্যাট আইন সংশোধন চান ব্যবসায়ীরা

দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে ভ্যাটের ভার কমালে উদ্যোক্তা এবং ভোক্তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হবে না বলে মনে করছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সংগঠনটি বলেছে- নিম্ন আয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যবহার্য পণ্য, সাধারণ পণ্য পরিবহন, নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবা খাতে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে আসছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মূল্য সংযোজন কর- মূসক বা ভ্যাট আইন ও বিধিমালা সংশোধন চেয়েছে এফবিসিসিআই।

গতকাল রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর এবং বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন- এফবিসিসিআই আয়োজিত জাতীয় বাজেট পরামর্শক কমিটির ৪২তম সভায় দেওয়া প্রস্তাবে এসব কথা বলেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এমপি। সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। সভায় দেশের বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনের নেতারা মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন।

ওই মতবিনিময় সভায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন- আগামী অর্থবছরের বাজেটের মূল থিম হচ্ছে সবার জন্য সমান সুযোগ। ব্যবসায়ীরাও ঠকবে না আবার সরকারও জিতবে। সরকার সব ক্ষেত্রে বেশি নিল ব্যবসায়ীরা কিছু পেল না- এ অভিযোগ সরকার শুনতে চায় না। গত ১৩ বছরে রাজস্ব আট গুণ বেড়েছে। এতে ব্যবসায়ীদের অবদান রয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের এটিও মনে রাখতে হবে আগামীতেও কর পরিশোধ করতে হবে। তা না হলে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প কীভাবে বাস্তবায়ন হবে অথবা মেগা প্রকল্প সরকার কীভাবে শেষ করবে। সরকার পরোক্ষ কর থেকে সরে এসে প্রত্যক্ষ করের দিকে এগোচ্ছে। 

ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন- ‘আপনাদের কর দিতে হবে। কর না দিলে পদ্মা সেতু কীভাবে হবে? মেগা প্রকল্প শেষ হবে কীভাবে?’ তিনি আরও বলেন, আগামী বাজেট হবে সবার জন্য লাভজনক। ব্যবসায়ীরা ঠকবেন না, তাঁরা ঠকলে দেশ পিছিয়ে যাবে। শুল্ক-কর কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে কাজ করাতে হয়- ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগের প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আপনারা ঘুষ দিচ্ছেন কেন? আপনাদের কাছে অনুরোধ, ঘুষ দেবেন না।’ এ সময় হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘ঘুষ দেওয়া যাবে না। যারা ঘুষ দেয়, তাদের জায়গা হবে জাহান্নামে। এভাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যবসায়ীদের সতর্ক করেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন- কিছু কর্মকর্তা ও গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর কারণে এনবিআরের বদনাম হচ্ছে। কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা-ব্যবসায়ীর কারণে পুরো সংস্থার ওপর দায় পড়ে। এ জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানের কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, কর ফাঁকি ধরার জন্য এনবিআর কোনো কর্মকর্তাকে কমিশন দেয় না। পুরস্কার বা প্রণোদনা দেওয়া হয়। উন্নত দেশ গড়তে শিল্পায়নের বিকল্প নেই। শিল্পায়ন সহজ করতে বাণিজ্য বাড়াতে হবে। ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন- আমার খুব কষ্ট হয়, যখন অল্পকিছু বিপথগামী শুল্ক-কর কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীর জন্য রাজস্ব বিভাগের বদনাম হয়। আমরা উভয়ের মধ্যে বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব চাই। সমালোচনা নয়, সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির মামলা দেওয়ার বিষয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেন- কর আহরণের সময় আয়কর দাতা বা আয়কর আহরণকারী কারও না কারও ভুল হতে পারে। তার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ঠিক নয়। ব্যবসায়ীদের ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের দেশে পাইকারি পর্যায়ে ভ্যাট রেট অনেক বেশি। পাইকারি ভ্যাট হার কমাতে হবে। ওই সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন করদাতাদের হয়রানি না করার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, নিরীক্ষা ও পরিদর্শন-সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বিধি মোতাবেক পরিচালনা করা উচিত। এতে হয়রানিমুক্ত থাকবেন ব্যবসায়ীরা। এফবিসিসিআই আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য মৌলিক বাজেট প্রস্তাবে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। এসব লিখিত প্রস্তাবে রপ্তানি খাতসহ সব শিল্প খাতে উৎসে কর ও আগাম কর ফেরত দেওয়ার পরিবর্তে পুরো বিলোপের সুপারিশ করেছে এফবিসিসিআই। ব্যবসায়ে অহেতুক খরচ ও সময় কমানোর জন্য এ সুপারিশ করেছে সংগঠনটি। এ ছাড়া জমি ক্রয়, নির্মাণ, পরিষেবার বিলসহ সব সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) প্রত্যাহার চায় এফবিসিসিআই।

এফবিসিসিআই অতিক্ষুদ্র ও কুটির, ক্ষুদ্র, মাঝারি (সিএমএসএমই) ও বৃহৎ শিল্পের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। সংগঠনটি অতিক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে আট বছর পর্যন্ত কর অবকাশ-সুবিধা দিতে সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়া যেসব ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার তথা লেনদেন ৫০ কোটি টাকার নিচে, সেগুলোর মূসক হার ৩ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা এবং এসব প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল, উপকরণ ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কহার ১ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। বার্ষিক লেনদেন ৩০০ কোটি টাকার নিচে, এমন মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মূসক হার ৪ থেকে ৬ শতাংশ এবং এসব প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল, উপকরণ ও যন্ত্রপাতির শুল্কহার ১ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে রাখতে বলেছে এফবিসিসিআই। আর ৩০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়, এমন ধরনের বড় প্রতিষ্ঠানের সব কাঁচামাল, উপকরণ ও যন্ত্রপাতিতে শুল্কহার ১ থেকে ৩ শতাংশ নির্ধারণের সুপারিশ করেছে তারা। সেই সঙ্গে অনুন্নত এলাকায় শিল্পকারখানা করলে উদ্যোক্তাদের প্রথম আট বছর কর-সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করেছে তারা। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠনটি আমদানি পর্যায়ে শুল্কস্তর পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবটি এ রকম : এতে তৈরি পণ্যে ২৫ শতাংশ; দেশে উৎপাদিত হয় এমন যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও মধ্যবর্তী কাঁচামালে ৭ থেকে ১০ শতাংশ; মৌলিক ও দেশে উৎপাদিত হয় না এমন মধ্যবর্তী কাঁচামালে ১ থেকে ৩ শতাংশ এবং শিল্প খাতের যন্ত্রপাতি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করা। আয়কর নিয়েও একগুচ্ছ প্রস্তাব রয়েছে এফবিসিসিআইয়ের। যেমন বেতন, ফি, সুদ ও লভ্যাংশ ছাড়া অন্য লেনদেন ও প্রাপ্তির ওপর উৎসে আয়কর এবং আমদানিকালে আরোপিত আয়কর প্রত্যাহার করা। এ ছাড়া সংগঠনটি কেবল চূড়ান্ত করযোগ্য নিট আয়ের ভিত্তিতে ব্যবসা বা পেশার ওপর আয়কর আরোপের প্রস্তাবও করেছে। এ ছাড়া এফবিসিসিআই সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন কাজে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ও কর পরিশোধের প্রমাণ দাখিল বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি কর নিবন্ধনের বিভিন্ন দলিলকে বিনিয়োগ দলিল হিসেবে বিবেচনা করার প্রস্তাব দিয়েছে।

সর্বশেষ খবর