মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

ইতিহাসের বাতিঘর স্বাধীনতা জাদুঘর

মোস্তফা মতিহার

ইতিহাসের বাতিঘর স্বাধীনতা জাদুঘর

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মুক্তিযুদ্ধ একই সুতায় গাঁথা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকেই অগ্নিঝরা ’৭১-এ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে মুক্তিকামী বাঙালি পরাধীনতার শিকল ভাঙার শপথ নেয়। ৯ মাসের রক্তস্নাত যুদ্ধ শেষে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে এই উদ্যানেই মিত্রবাহিনীর কাছে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে যুক্ত হয় সবুজ শ্যামল স্বদেশের মানচিত্র। পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলে লাল-সবুজের পতাকা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় স্বাধীনভাবে। রক্তের বিনিময়ে তৈরি হয় মুক্তির ইতিহাস। যার কারণে স্বাধীনতার গর্বিত ইতিহাসে কালের সাক্ষী সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যেই ইতিহাসের সাক্ষী এই উদ্যানে তৈরি করা হয়েছে দেশের প্রথম ভূগর্ভস্থ ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্য অনুধাবন করে এই জাদুঘরটি নির্মাণ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তিন দিক পানি দিয়ে ঘেরা মাটির নিচের জাদুঘরে রয়েছে আলোকচিত্র, প্রামাণ্য দলিল, প্যানেল ফটোগ্রাফি আর বিষাদের ফোয়ারা। বাংলা ভাষার উৎপত্তি, বাংলার উৎপত্তি ও স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন সময়কার আন্দোলন, ২৫ মার্চ কালরাত্রির নির্মম গণহত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রশিক্ষণ, অপারেশন ও আন্তর্জাতিক সমর্থন এই তিন ভাগে সাজানো রয়েছে জাদুঘরটি। তিন ভাগের এই ছবি ও প্রামাণ্য দলিলগুলোতে উঠে এসেছে ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬ এর ছয় দফা ও ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের নানা চিত্র। সবুজে ঘেরা নয়নাভিরাম উদ্যানের এই জাদুঘরে প্রবেশের আগেই চোখে পড়বে কাচ দিয়ে ঘেরা ১৫০ ফুটের ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’। এই স্তম্ভের পাশেই টেরাকোটা ম্যুরালে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার বিভিন্ন প্রামাণ্য মুহূর্ত খচিত দেয়াল শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি আগ্রহীই করে তুলবে না, এর নান্দনিকতায় শিল্পরসিকদের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে ভালো লাগার অনুভূতিতে। ভালো লাগার অনুভূতি শেষ না হতেই মাটির নিচে নিয়ে যাবে ওপরে থাকা সিঁড়িটি। গহিন সুড়ঙ্গের মতো সিঁড়ি ভেদ করলেই চোখে ভেসে উঠবে বাঙালির নানা সময়ের মুক্তির ইতিহাস। ’৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে থেকে ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি, ’৫৪ এর ২১ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খালি পায়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, ’৫৪ এর নির্বাচন, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পর পল্টন ময়দানের জনসভার একাংশ, আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুকে ট্রাইব্যুনালে নেওয়ার সময়কার ছবি, আগরতলা মামলার ইতিহাস, ’৭০ সালের নির্বাচন, জাতীয় চার নেতার ছবি, শরণার্থী শিবিরের পথে বাঙালি, নির্যাতিতা নারীদের নির্যাতনের বীভৎস চিত্র, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের ছবি ও সাক্ষাৎকার, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, চিফ অব স্টাফ, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ও সেক্টর কমান্ডারদের ছবি, ’৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবি, পাশেই কাচের ভিতর সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে আত্মসমর্পণের সময় ব্যবহৃত টেবিল। এ রকম প্রায় শতাধিক ছবিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির ইতিহাস। আর কালের সাক্ষী হিসেবে গ্যালারির দেয়ালের বাইরের খালি জায়গায় রাখা হয়েছে কাচের প্যানেল। আর সেই প্যানেলে রয়েছে ১৪৪টি প্রামাণ্য দলিল। এই প্যানেলে রয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, অস্থায়ী সরকারের শপথ, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, বাংলাদেশের প্রাচীন, মধ্যযুগ এবং সমকালীন ইতিহাস, স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিবাহিনী গঠন, প্রশিক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধ, উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৭৫৭-১৯৪৭), ভাষা আন্দোলন (১৯৪৮-৫৪), স্বাধিকার আন্দোলন (১৯৫৪-৭০), বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতা ও বিদেশি পত্র-পত্রিকার প্রতিক্রিয়া, প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ, স্বাধীনতা অর্জনের দ্যুতিময় প্রকাশ ইত্যাদি ১৪৬টি প্যানেল ফটোগ্রাফি স্থান পেয়েছে এতে। অন্যদিকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালিদের ওপর পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতন, গণহত্যা ও গণহত্যার শহীদদের স্মরণে রাখা হয়েছে ‘ব্ল্যাক জোন’ নামের একটি গ্যালারি। বিদঘুটে অন্ধকারে কালো রঙে আচ্ছাদিত গ্যালারির এই অংশটিতে বৈদ্যুতিক আলোর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গণহত্যার নির্মমতার ছবিগুলো। ‘ব্ল্যাক জোন’ নামে চিহ্নিত এই গ্যালারিতে গণহত্যার বীভৎসতার সেই চিত্রগুলো যে কাউকেই শিউরে তুলবে। এখানকার ৯৩টি ছবি ঘৃণিত পাক হানাদার বাহিনীর প্রতি নতুন করে ঘৃণা তৈরি করবে নতুন প্রজন্মের মাঝে। প্যানেল ফটোগ্রাফি, গ্যালারির ফটোগ্রাফি এবং ব্ল্যাক জোনের ছবিগুলো দেখার পর ‘মায়ের কান্না’ নামের কৃত্রিম ফোয়ারাটি দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করার পাশাপাশি শোকাবহ ও আবেগী করে তুলবে। মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের মায়ের অশ্রুকে নির্দেশ করে নির্মাণ করা হয়েছে প্রতীকী এই ফোয়ারাটি। গ্যালারির বাইরে খালি জায়গায় স্থাপিত প্রতীকী এই ‘মায়ের কান্না’ ফোয়ারাটির চারপাশে অন্ধকার। আধো রঙিন আলোতে এটি নেমে এসেছে মাটির উপরিভাগ থেকে। ফোয়ারাটির পানিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের মায়ের কান্না। বিষাদে ভারী করে তোলা হয়েছে এর চারপাশ। যত কঠিন হৃদয়ের মানুষই হোক না কেন প্রতীকী এই ‘মায়ের কান্না’ ফোয়ারার কাছে এলে তাদের পাষাণ হৃদয়ও বিগলিত হবে। ঘৃণা জমে উঠবে রাজাকার ও পাকবাহিনীর প্রতি। ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অশ্রুতে সিক্ত হবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা।

মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত ইতিহাস দেখতে প্রতিদিনই শত শত দর্শনার্থী ছুটে আসেন এখানে। চোখজুড়ানোর পাশাপাশি জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে মোবাইলের ক্যামেরায় ইতিহাসের সঙ্গে নিজেদের স্মৃতিবহ করে রাখতেও ভুল করেন না দর্শনার্থীরা। জাদুঘরে কথা হয় রাজধানীর জুরাইন থেকে আসা রাজু-দোলা দম্পতির সঙ্গে। তারা বলেন, এখানে এই প্রথম এলাম। খুবই ভালো লাগছে। এই জাদুঘরটি আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য আশীর্বাদ বলেই মনে করছি। এখানে এসে মুক্তিযুদ্ধের অনেক কিছু স্বচক্ষে দেখলাম। এতদিন বইতে পড়েছি, আর এখন ছবি দেখলাম। ভালো লাগার এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আশা করছি ভবিষ্যতে আরও আসব। ১২ জন স্টাফ দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে জাদুঘরের কার্যক্রম। প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা। ১০ বছরের নিচের শিশুদের জন্য ১০ টাকা। আর সাপ্তাহিক বন্ধ বৃহস্পতিবার। ২০১৬ সালের ২৬ মার্চ জাদুঘরটি উন্মুক্ত করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর