বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

সারা দেশে বাড়ছে ডায়রিয়া

অনেকের নমুনায় কলেরার জীবাণু

নিজস্ব প্রতিবেদক

সারা দেশে বাড়ছে ডায়রিয়া

ঢাকার পাশাপাশি সারা দেশেই বাড়ছে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব। একই সঙ্গে অনেক রোগীর নমুনায় মিলছে কলেরার জীবাণু। রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। ঢাকার মহাখালীতে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) বা কলেরা হাসপাতালে ভর্তি সক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি রোগী আসছেন প্রতিদিন। বাধ্য হয়ে অনেক রোগী পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বিদায় করে দিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছর সারা দেশে তিন লক্ষাধিক মানুষ ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকাতেই ভর্তি হয়েছেন লক্ষাধিক।

এদিকে বাইরে তাঁবু টাঙিয়েও রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে আইসিডিডিআরবি। হাসপাতাল সূত্র জানায়, হাসপাতালে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬০০ রোগী ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া যায়। প্রতিদিন আসছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ রোগী। ৬০ বছরের মধ্যে রেকর্ড সংখ্যক রোগী ভর্তি হয়েছে এ বছর। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে সব বিভাগে ও জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডায়রিয়া।

আইসিডিডিআরবির গণসংযোগ বিভাগ জানায়, মার্চ থেকে এ পর্যন্ত কলেরা হাসপাতালে ৪৫ হাজারেরও বেশি ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। চলতি মাসের ১১ দিনেই চিকিৎসা নিয়েছেন ১৪ হাজার ২৬৬ জন। গতকাল দুপুর ২টা পর্যন্ত হাসপাতালে আসেন আরও ৬৮৫ জন। এদিকে গত এক মাসের ব্যবধানে আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের রেজিস্টারে ২৯ জনের মৃত্যু লিপিবদ্ধ হয়। তাদের মধ্যে ২৫ জনের মৃত্যুই হয় বাসা থেকে হাসপাতালে আনার পথে। হাসপাতালটির চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ঢাকা মহানগর ও আশপাশের এলাকা থেকে আসা অনেক ডায়রিয়া রোগীর মলে কলেরার জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে। কলেরার জীবাণুতে আক্রান্ত হলে বারবার মলত্যাগের পাশাপাশি রোগী ক্রমাগত বমি করতে পারে। রোগীর তৃষ্ণা বেড়ে যাওয়া, দ্রুত ক্লান্ত হওয়া, হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়া, কিডনি ফেইলরসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলেই দ্রুত খাবার স্যালাইন পান করালে রোগী দুর্বল হয় না। ঝুঁকি কমে যায়। এ ছাড়া দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া ও কলেরার চিকিৎসা সহজলভ্য। আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম বলেছেন, অপরিচ্ছন্ন, বাসি, দুর্গন্ধযুক্ত খাবার ও দূষিত পানি থেকে মূলত ডায়রিয়া ও কলেরার জীবাণু ছড়ায়। এ জন্য আমরা রাস্তার খোলা খাবার ও শরবত খেতে নিষেধ করি। খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধুতে বলি।

দেশের বিভিন্ন বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় থেকে ডায়রিয়া পরিস্থিতির খবর পাঠিয়েছেন আমাদের সংবাদকর্মীরা-

সিলেট : সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল মিলে ভর্তি আছেন ৩৩ জন রোগী। এ ছাড়া প্রতিদিন অনেকে হাসপাতাল দুটির আউটডোরে ডাক্তার দেখিয়ে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বাসায় চলে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

সাতক্ষীরা : গত এক সপ্তাহে সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতালে ৮৭০ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। ৫০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালে বর্তমানে বেডে ও বারান্দায় অবস্থান নিয়ে ৭০ জনের মতো রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. মো. আবুল বাশার আরমান জানান, গত মার্চ মাসে বহির্বিভাগ থেকে ৩ হাজারের বেশি ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। আরও ৩৫০ জন হাসপাতালে অবস্থান করে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। গত এক সপ্তাহে রোগী দ্বিগুণ বেড়েছে। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে গতকাল ছয়জন ভর্তি ছিলেন।

ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী। নগরীর সূর্যকান্ত (এসকে) হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৩০ থেকে ৪০ জন। মমেক হাসপাতালের ৩০ এবং ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, সর্দি জ্বরে ভর্তি রয়েছেন ৩২০ জনের মতো শিশু। হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় ঠাঁই হয়েছে অনেকের।

মানিকগঞ্জ : মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের জন্য মাত্র ১০টি বেড বরাদ্দ রয়েছে। প্রতিদিন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে ৮-১০ জন। শয্যা না থাকায় রোগীরা মেঝেতে থেকে সেবা নিচ্ছেন। রোগীর স্বজনরা জানান, ডায়রিয়া ইউনিট একবারেই নোংরা আবর্জনায় ভর্তি। এখানে সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

গাজীপুর : গাজীপুরে গত মার্চেই ৪ হাজার ৮৫ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। চলতি মাসের গত ৭ দিনে ৩৪৬ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১০২ জন ডায়রিয়া রোগী পাওয়া গেছে। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ৪২ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি রয়েছেন।

চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় গত সোমবার এক দিনে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১২০ জন, গত রবিবার চিকিৎসা নেন ১৪২ জন ও শনিবার ১২৯ জন। চট্টগ্রামে গত সাত দিনে মোট ৫৯৯ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং সুস্থ হয়েছেন ৪২৫ জন। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছেন আটজন এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩০ জন। চট্টগ্রাম নগরীর চেয়ে উপজেলাগুলোয় ডায়রিয়া পরিস্থিতি নাজুক বলে চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানা গেছে।

বরগুনা : সিভিল সার্জন অফিসের তথ্যমতে, জানুয়ারি থেকে ১২ এপ্রিল বেলা ১০টা পর্যন্ত বরগুনায় সরকারি হাসপাতালে ১ হাজার ৭০৫ জন ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি। সদর উপজেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২১৮ জন ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে নারী ও শিশু বেশি। পুকুরের পানি পান করায় বরগুনায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ছে বলে জানা গেছে।

পটুয়াখালী : গত ২৪ ঘণ্টায় পটুয়াখালীতে ৫২ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, নিয়ম মেনে চললেই ডায়রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আক্রান্ত রোগীরা পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, ১ জানুয়ারি থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত জেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৫৪৭ জন। গত এক মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৫৫৯ জন। গত সাত দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩৮৫ জন।

রাজশাহী : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিনই গড়ে ১০০-এর কাছাকাছি ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হচ্ছেন। গত ১২ দিনে হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ১৫৫ জন। ডায়রিয়া রোগী বাড়তে থাকায় শয্যা খালি নেই শিশু, নারী ও মেডিসিন ওয়ার্ডে। মানুষের চলাচলের রাস্তায়, মেঝেতে থাকছেন রোগীরা।

রাজবাড়ী : সোমবার মধ্যরাত থেকে গতকাল দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ৪৫ জন রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ১২ শয্যার বিপরীতে ৬০ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন।

নোয়াখালী : ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে গত ১২ দিনে মোট ২৬৩ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৭৭ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

নড়াইল : নড়াইল সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর জন্য ছয়টি শয্যা বরাদ্দ থাকলেও ভর্তি রয়েছেন ২৫ জন। গত এক মাসে ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১৭ জন রোগী। প্রতিদিন বহির্বিভাগে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জন ডায়রিয়া রোগী আসছেন চিকিৎসা নিতে।

মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে গতকাল বিভিন্ন বয়সের ১৮ জন নারী ও পুরুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ২৬ রোগী ছিল, যার মধ্যে আটজন রোগী চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন।

মেহেরপুর : মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া বিভাগের নার্সিং ইনচার্জ নিপা আক্তার জানান, গত এক সপ্তাহে ১৪০ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ১২০ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ১২ শয্যার বিপরীতে গত ২৪ ঘণ্টায় ২০-২৫ জন রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। গত এক সপ্তাহে এখানে দেড় শতাধিক রোগী চিকিৎসা নেয়।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মাহবুব হোসেন জানান, প্রতিদিন গড়ে ১৬ থেকে ১৮ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি থাকেন। বর্তমানে ২৪ জন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

চুয়াডাঙ্গা : গত এক সপ্তাহে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ১১২ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছেন।

বগুড়া : সরকারি হিসাবে গতকাল জেলায় ৮০ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১৭ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

ভোলা : গতকাল দুপুরে ভোলা সদর হাসপাতালে ১০ বেডের ডায়রিয়া ইউনিটে ১৫ জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। কর্তব্যরত সেবিকা জানান, প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী ভর্তি হন।

বাগেরহাট প্রতিনিধি : বাগেরহাট ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে গতকাল দুপুরে চার শয্যার বিপরীতে ভর্তি ছিলেন ২৯ জন। শয্যা সংকুলান না হওয়ায় মেঝের পাশাপাশি আইসোলেশন ওয়ার্ডের দুটি কক্ষে দেওয়া হচ্ছে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা। সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত এক সপ্তাহে বাগেরহাট জেলা হাসপাতালে প্রায় ২০০ জন ও জেলার অন্য ৯টি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সাড়ে সাত শতাধিক ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

বরিশাল : বিভাগে গড়ে প্রতিদিন ৪০০ মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয়ের উপপরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল জানান, এপ্রিলের শুরুর দিকে বরিশালে ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ জন আক্রান্ত হচ্ছেন।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর