বুধবার, ২০ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

অনিশ্চয়তায় ৭০০ মামলার ডিএনএ নমুনা

♦ ৮ মাস মেশিন বন্ধ থাকায় জট লেগেছে সাড়ে ৩ হাজার নমুনার ♦ মেরামতের পরও মিলছে না সঠিক ফল

মাহবুব মমতাজী

ল্যাব পরীক্ষার সংকটে অন্তত ৭০০ মামলার ডিএনএ নমুনার ফলাফল প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এসব নমুনা রয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে। মন্ত্রণালয়ের ‘মাল্টি-সেক্টোরাল প্রোগ্রাম অন ভায়োলেন্স অ্যাগেইন্সট উইমেন’ প্রকল্পের অধীনে ল্যাবটি। গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর ল্যাবের মেশিন নষ্ট হয়ে পড়েছিল। প্রায় ৭ মাস ল্যাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর চলতি মাসের শুরুর দিকে তা মেরামত করা হয়। মেরামতের পরও মিলছে না সঠিক ফল। এতে ১ হাজারের বেশি মামলার প্রায় সাড়ে ৩ হাজার নমুনার জট লেগে যায়। ফলে এসব মামলার তদন্ত কার্যক্রম ঝুলে যায়।

এ ছাড়া যে প্রকল্পের অধীনে ল্যাবটি চলছিল আগামী জুনে তার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এতে ল্যাবে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ৫৩ জনের চাকরিও অনিশ্চয়তায় পড়েছে। একই সঙ্গে ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ প্রক্রিয়া এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেও দেখা দিয়েছে আরেক অনিশ্চয়তা। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা ও বিচারপ্রার্থীরা।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ডিএনএ আইন হওয়ার পর ডিএনএ অধিদফতর হয়েছে। সেটাতে প্রায় ৬৪টি পদ তৈরি হয়েছে। ওইসব পদে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হবে। পুরনো যারা কর্মরত ছিলেন, এই ৫৩ জনকে সেখানে নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে ডেনমার্ক সরকারের আর্থিক সহায়তায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) চালু করে ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি। ডাটা সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই কোডিস নামে একটি সফটওয়ার দেয়। এরপর অন্তত ৪ বার মেয়াদ বাড়ানো হয় ল্যাব প্রকল্পটির। সর্বশেষ মেয়াদ বৃদ্ধি হয় ২০১৭ সালে। ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৭ হাজার ৫০০টি মামলার ২৩ হাজার ৮৮৯টি ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয় এই ল্যাবে। গত বছর পিতা-মাতা নির্ধারণে ১১৯টি মামলার ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ৮৩০টি ধর্ষণ মামলার ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়েছে। সব মিলে ১ হাজার ৫৭টি মামলার ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়েছে ল্যাবটিতে। এর মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রায় ৩০০টি মামলার ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। আটকে আছে ৭০০ মামলার ডিএনএ পরীক্ষা। এ ছাড়া আসামি না পাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে ২০০টি ধর্ষণ মামলার ডিএনএ পরীক্ষা অসম্পূর্ণ রয়েছে।

গতকাল মিরপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রফিকুল ইসলাম জানান, একটি ধর্ষণ মামলার ডিএনএ পরীক্ষার জন্য দেওয়া হয়েছিল ফরেনসিক ল্যাবে। সেখানে কর্মরতরা জানান, মেশিন নষ্ট। বাধ্য হয়ে অন্য একটি আবেদন দিয়ে নমুনা ফেরত আনা হচ্ছে। ল্যাবে কর্মরত ডিএনএ অ্যানালিস্টরা বলছেন, ল্যাবে মেশিন নষ্ট থাকায় নমুনা পরীক্ষায় জট লাগে। এরপর মেশিন ঠিক হওয়ার পরও ফল ভালো আসছে না। আর মাত্র এক মাস পরই প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ল্যাবটি চলবে কি, চলবে না তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। সেই সঙ্গে আমাদের চাকরিও অনিশ্চিয়তার মধ্যে চলছে। অথচ প্রায় ২০ বছর ধরে শ্রম দিয়ে ল্যাবটি আমরা চালু রেখেছিলাম। রাজস্ব খাতে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আমাদের ল্যাবে কর্মরত রাখা হয়েছিল। এখন আমাদের বাদ দিয়ে পৃথক ল্যাব স্থাপন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় ন্যাশনাল ফরেনসিক ল্যাবের জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক শরীফ আখতারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা সমস্যায় আছি। এ নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। তিনি প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। ‘মাল্টি-সেক্টোরাল প্রোগ্রাম অন ভায়োলেন্স অ্যাগেইন্সট উইমেন’ প্রকল্পের পরিচালক নার্গিস খানম এ প্রতিবেদককে বলেন, জুনে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে আরও দেড় বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। কারণ ডিএনএ অধিদফতর এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। ল্যাবটি বন্ধ করে সব কার্যক্রম ডিএনএ অধিদফতরে স্থানান্তর সময়ের ব্যাপার। আর ডিএনএ অধিদফতরের নিয়োগ বিধি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এরপর তারা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন। সেখানে বয়সের বিষয়টিও নির্ধারণ করা আছে। এর মধ্যে যারা দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরে পুরনো ল্যাবটিতে শ্রম দিয়েছেন, সেই ল্যাবটি আর থাকছে না। আর সেখানে কর্মরতদের ডিএনএ অধিদফতরে নেওয়ার ক্ষেত্রে আইন ও বিধিতে কোনো সুযোগ নেই। এতদিন কর্মরত থাকার পরও তাদের চাকরি অনিশ্চয়তায় রয়েছে এটা আমরা বলতেই পারি। এদিকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ ও শনাক্তকরণ, নমুনা ও তথ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন, জাতীয় ডিএনএ ডাটাবেজ প্রস্তুতকরণ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) আইন প্রণয়ন করে সরকার। এই আইনের অন্যান্য কার্যবিধিও পরিচালিত হবে ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মাধ্যমে। বর্তমানে রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজসহ বিভাগীয় ল্যাবরেটরিগুলো নমুনা সংগ্রহ করে পাঠায় ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে। এই ল্যাবে রানা প্লাজা ধস, তাজরীন ফ্যাশনে আগুনের মতো দুর্ঘটনায় ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমেই ভুক্তভোগীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। এখানে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে কিডনি পাচারের মতো বেআইনি কার্যক্রম বন্ধেও ভূমিকা রাখা হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর