বুধবার, ২৫ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সোনালী ব্যাংক ইউকে প্রবাসীদের গর্ব এখন লজ্জার নাম

আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সোনালী ব্যাংক ইউকে প্রবাসীদের গর্ব এখন লজ্জার নাম

যুক্তরাজ্যে সোনালী ব্যাংকের অফিস -বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রায় ছয় বছর ধরে সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডের ব্যাংকিং কোনো কার্যক্রম ছিল না। এর পরও ব্রিকলেনের প্রবেশমুখে অসবর্ণ স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে থাকা ভবনে সোনালী অক্ষরে লেখা সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেড ছিল প্রবাসীদের গর্বের প্রতীক। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত গর্বের সেই ব্যাংকটি এখন ব্রিটেনে লজ্জার নাম। আগামী ১৬ আগস্ট বন্ধ হয়ে যাবে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের গর্বের নাম সোনালী ব্যাংক। অর্থ পাচার প্রতিরোধে ব্যর্থতা ও বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা-অনিয়ম-দুর্নীতিতে ধুঁকতে থাকা ব্যাংকটিকে বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। এ সংবাদে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে।

কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ নাহাস পাশা বলছিলেন, ব্রিটেনে ভারতীয় ব্যাংক রয়েছে, পাকিস্তানি ব্যাংক রয়েছে, অথচ বাংলাদেশের ব্যাংকের শুধু বদনাম আর বদনাম!

উল্লেখ্য, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ১৫টি ব্যাংকের অন্তত ৩০টির বেশি শাখা রয়েছে ব্রিটেনে। তাই বাংলাদেশের মাত্র একটি ব্যাংক ব্রিটেনে টিকতে পারল না। এ জন্য সৈয়দ নাহাস পাশা হতাশায় বলেন, যে কমপ্লায়েন্সের জন্য বছরে কোটি টাকার ওপরে বেতন দিয়ে একাধিক কমপ্লায়েন্স অফিসার রাখা হলো, সেই কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে ব্যাংক শেষ পর্যন্ত বন্ধই করে দেওয়া হলো! সৈয়দ নাহাস পাশাও একসময় সোনালী ব্যাংক ইউকের গ্রাহক ছিলেন। ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর যখন ব্যাংকটির কার্যক্রম বন্ধ হয় তখন সৈয়দ নাহাস পাশা নিজের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে টাকা তুলে নেন। সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেড ব্রিটেনের প্রধান তিন শহর লন্ডন, ওল্ডহ্যাম ও বার্মিংহাম থেকে পরিচালিত হলেও ২০১৩ সালের ২ জুন সোনালী ব্যাংক ইউকের ওল্ডহ্যাম শাখা থেকে সুইফট কোড জালিয়াতির মাধ্যমে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার হাতিয়ে নেওয়া হয়। ওই শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক ইকবাল আহমেদ ব্যাংকের ভল্ট থেকে অর্থ চুরি, গ্রাহকের হিসাব থেকে অবৈধভাবে অর্থ উত্তোলন ও গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর শাখাটি বন্ধ করে দেয় ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। ২০১৭ সাল থেকে চালু আছে শুধু লন্ডন ও বার্মিংহাম শাখা। ২০১০ সালের ২০ আগস্ট থেকে ২০১৪ সালের ২১ জুলাই সময়ে অর্থ পাচার প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডকে ৩২ লাখ পাউন্ড জরিমানা করে দেশটির আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফসিএ। বন্ধ করে দেয় নতুন হিসাব খোলা। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংক ইউকের মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ বিভাগের প্রধান স্টিভেন স্মিথকে এ ধরনের চাকরিতে নিষিদ্ধ ও ১৮ হাজার পাউন্ড জরিমানা করা হয়। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রুডেন্সিয়াল রেগুলেশন অথরিটি (পিআরএ) ও ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটির (এফসিএ) সিদ্ধান্তে বন্ধ হচ্ছে সোনালী ব্যাংক ইউকে। ২৭ জানুয়ারি বিষয়টি সোনালী ব্যাংক ইউকেকে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় যুক্তরাজ্যে অবস্থিত ব্যাংকটিকে বাঁচাতে তৎপর হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এ জন্য সোনালী ব্যাংক ইউকের পরিবর্তে যুক্তরাজ্যে দুটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। মোট চারটি প্রস্তাব দিয়ে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠাচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। প্রস্তাবে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য ‘সোনালী পে ইউকে লিমিটেড’ এবং বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর ঋণপত্রের নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য ‘সোনালী বাংলাদেশ (ইউকে) লিমিটেড’ নামে কোম্পানি তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সোনালী পে ইউকের লাইসেন্সের জন্য বাংলাদেশ থেকে আরও ১০ লাখ পাউন্ড মূলধন জোগান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর যদি প্রধানমন্ত্রী চান তাহলে তিনি পুরো কার্যক্রম বন্ধ করে সোনালী ব্যাংকের পুরো অধ্যায় গুটিয়ে নিতে পারেন। সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন করে যে তিন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এর মধ্যে প্রথম দুটি সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সে ক্ষেত্রে বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেড সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশে সোনালী ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতাউর রহমান প্রধান যখন ইউকে শাখার দায়িত্বে ছিলেন সেই সময়। তার দায়িত্বে অবহেলা, সুপারভাইজরি ঘাটতি ও অন্যান্য কারণে ৭৬ হাজার ৪০০ পাউন্ড জরিমানা করা হয়। ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর আতাউর রহমান প্রধানের বিরুদ্ধে আরোপিত শাস্তির সিদ্ধান্ত এফসিএর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকেই সোনালী ব্যাংক ইউকের ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পর থেকে ব্যাংকটি কেবল ট্রেড ফাইন্যান্স ও রেমিট্যান্স হাউস হিসেবে সচল রয়েছে। যিনি এত বড় শাস্তি পেয়ে দেশের নাম লজ্জায় ডুবিয়েছেন তিনিই বাংলাদেশে যাওয়ার পর পুরস্কৃত হয়েছেন, দায়িত্বে রয়েছেন সোনালী ব্যাংকের! এতে হতাশা ব্যক্ত করেন লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি নবাব উদ্দিন। তিনি বলেন, যিনি ব্রিটেনে ব্যাংকিং খাত ডুবিয়ে গেছেন তিনিই কি না এখন আবার আরও বড় দায়িত্বে! যার শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল তিনিই হলেন পুরস্কৃত। এভাবেই দেশের ব্যাংকিং খাত আজ ব্যর্থ। ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহ-সভাপতি মহিব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ব্যাংক বোঝেন না এমন লোকদের স্বজনপ্রীতি করে দায়িত্বে পাঠানোর কারণেই আজ ব্রিটেনের মাটিতে আমাদের গর্বের এক প্রতিষ্ঠান প্রায় হারাতে বসেছে। তিনি হতাশা নিয়ে বলেন, বাংলাদেশের কত পজেটিভ জিনিস আমাদের অনুপ্রাণিত করে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি, বাংলাদেশ সরকারের বৈধ পথে রেমিটেন্স পাঠানোর জন্য নানা কার্যক্রম সবকিছু ম্লান করে দেয় সোনালী ব্যাংকের এই ব্যর্থতা।

 

সর্বশেষ খবর