রবিবার, ২৯ মে, ২০২২ ০০:০০ টা
সিলেটে বন্যার ঘোলা পানির প্রভাব

মেঘনায় মিলছে না ইলিশ

উবায়দুল্লাহ বাদল, চাঁদপুর থেকে ফিরে

মেঘনায় মিলছে না ইলিশ

ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিল দুই মাস ইলিশ ধরায় ছিল নিষেধাজ্ঞা। সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষ হতেই বুকভরা আশা নিয়ে মেঘনায় মাছ ধরতে নামে জেলেরা। কিন্তু মেঘনায় মিলছে না কাক্সিক্ষত ইলিশ। জ্বালানি তেলসহ ৩ হাজার টাকার বাজার খরচ নিয়ে ভোরে ১০ জন ভাগীদার জেলে জাল-নৌকা নিয়ে মেঘনায় নামেন মোশতাক মাঝি। দুইবার জাল ফেলে ৮০০ ও ৪০০ গ্রাম ওজনের দুটি ইলিশ ও একটি ছোট তপসে মাছ পান; যা বিক্রি হয়েছে মাত্র ২ হাজার টাকায়। ১০ জন জেলের সারা দিনের পারিশ্রমিক বাদ দিলেও মোশতাক মাঝির ঘাটতি আরও ১ হাজার টাকা। এ অবস্থা শুধু মোশতাক মাঝিরই নয়, মেঘনার অধিকাংশ জেলেরই একই অবস্থা। মাছ বিক্রি করে আয় তো দূরের কথা, তাদের খরচের টাকাও উঠছে না। এ নিয়ে জেলেদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম হাহাকার। হতাশ হয়ে অনেকে মাছ ধরাই বন্ধ করে দিয়েছে। জেলে ও মৎস্য গবেষকরা বলছেন, স্বাভাবিক নিয়মে এ সময় নদীতে ইলিশ পাওয়ার কথা। কিন্তু সিলেটে বন্যার কারণে উজান থেকে নেমে আসা পানি মিশে মেঘনার পানি ঘোলায় পরিণত হয়েছে। এর ফলে মিলছে না কাক্সিক্ষত ইলিশ মাছ। ২৬ মে চাঁদপুরের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)-এর গবেষণা তরীতে মেঘনায় ইলিশের পরিমাণ ও জেলেদের অবস্থা জানতে সরেজমিন গিয়েছিলেন ঢাকার জাতীয় দৈনিকের একদল সাংবাদিক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ইলিশ গবেষণা জোরদার প্রকল্পের পরিচালক মো. আবুল বাসারসহ কয়েকজন মৎস্য গবেষক ও বাংলাদেশ ফিশিং বোট মালিক সমিতির আহ্বায়ক শাহ আলম মল্লিক। তারা ইলিশ ধরার চ্যানেল চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার কাটাখালী এলাকায় মেঘনা নদীতে জেলেদের জাল ফেলা, টানা ও মাছ ধরার দৃশ্য সরেজমিন দেখেন।

মেঘনার ইলিশের আকালের কথা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের পরিচালক ড. মো. হারুনুর রশিদ। বৃহস্পতিবার তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অন্যান্য বছরের এই সময় সাধারণত মেঘনায় প্রচুর ইলিশের দেখা মেলে। সম্প্রতি সিলেটের ভয়াবহ বন্যার পানি পড়েছে মেঘনায়। উজানের ওই বন্যার ঘোলা পানি নদীতে মিশে যাওয়ায় ইলিশের দেখা মিলছে না। মাছ না পাওয়ায় অনেক জেলে ইলিশ ধরা বন্ধ করে দিয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলে এবং মেঘনার পানি স্বাভাবিক হলে দেখা মিলতে পারে কাক্সিক্ষত ইলিশের।’ জানা গেছে, বছরের এই সময় সাধারণত মেঘনায় জেলেদের জাল ফেলা নৌকার সরব উপস্থিতি থাকে। এত বেশি জেলের আনাগোনা ও জাল ফেলা থাকে যে, ঠিকভাবে জাহাজ চালানো যায় না। জেলেদের অনুরোধে বিভিন্ন দিক ঘুরে ঘুরে যেতে হয়। অথচ বৃহস্পতিবার মেঘনা ছিল জেলে নৌকাশূন্য। অনেকটা নিষেধাজ্ঞার সময়ের মতো। এদিন প্রায় ১৮ কিলোমিটারের বেশি (৯ দশমিক ৭২ নটিক্যাল মাইল) গবেষণা জাহাজ চালানোর মধ্যে হাতে গোনা মাত্র ৮-১০টি জেলে নৌকা চোখে পড়েছে। সেগুলোর মধ্যে মাত্র একটি নৌকায় দুটো ইলিশ এবং একটি তপসে মাছ ধরা পড়ে। এ ছাড়া বাকি নৌকায় কোনো মাছ পাওয়া যায়নি। চাঁদপুরের হরিণার মোশতাক মাঝি জানান, ভোরে ১০ জন ভাগীদার জেলে নিয়ে জ্বালানি তেলসহ ৩ হাজার টাকার বাজার নিয়ে জাল নৌকা নিয়ে মেঘনা নদীতে আসেন। দুটি খেও বেয়ে পেয়েছেন দুটি মাছ। মাছ দুটি ২ হাজার টাকায় কিনে নেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)-এর গবেষণা তরীর কর্মকর্তারা। গবেষণা তরীর ফিশ ফাইন্ডার যন্ত্রের মাধ্যমে দেখা গেছে, এত বড় নদী অথচ সেখানে মাছের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। অনেক পথ চালানোর পর কালেভদ্রে কোথায় কোথাও দু-এক স্থানে মাছের অস্তিত্ব মিলেছে। তাও আবার আকারে ৪ থেকে ১০ সেন্টিমিটারের। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফিশিং বোট মালিক সমিতির আহ্বায়ক শাহ আলম মল্লিক বলেন, ‘ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে মার্চ ও এপ্রিল মাসজুড়ে দেশের ছয়টি অভয়াশ্রমে সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সরকার। মে মাসের শুরুতে মাছ ধরা শুরু হলেও আশানুরূপ মাছ মিলছে না। হতাশ হয়ে অনেক জেলে মাছ ধরাই বন্ধ করে দিয়েছেন।

প্রতিদিনের তেল খরচ এবং একটি নৌকায় জাল টানার জন্য যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন সে তুলনায় মাছের প্রাপ্তি খুবই কম। নদীতে নেমে তেল খরচই উঠছে না।’ এমতাবস্থায় জেলেদের জন্য আরও প্রণোদনা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালক মো. আবুল বাসার জানান, পরিষ্কার পানি ছাড়া ইলিশ বসবাস করে না। ঘোলা পানি দেখলেই তারা স্থান পরিবর্তন করে। সিলেটে বন্যার কারণে উজান থেকে নেমে আসা পানি মিশে মেঘনার পানি এখন ঘোলা হয়ে গেছে। ফলে জেলেরা এখন কাক্সিক্ষত ইলিশ পাচ্ছে না। স্বাভাবিক নিয়মে এ সময়ে নদীতে এখন ইলিশ পাওয়ার কথা। প্রাকৃতিক বিরুপতায় পদ্মা-মেঘনার পানি ঘোলা হওয়ায় এখন ইলিশের দেখা মিলছে না। তিনি বলেন, এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আশা করি মেঘনার পানি পরিষ্কার হলেই জেলেরা আশানুরূপ ইলিশ পাবে এবং এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর