মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

যৌন হয়রানি নিয়ে উৎকণ্ঠা

জিন্নাতুন নূর

যৌন হয়রানি নিয়ে উৎকণ্ঠা

উচ্চ আদালত এক যুগ আগে শিক্ষাঙ্গনসহ দেশের সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হলেও উচ্চ আদালতের গাইডলাইন মেনে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহনে বিভিন্ন বয়সী নারীরা অহরহ যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিভিন্ন যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বলেন, সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি রোধে কমিটি গঠন করা হয়েছি কি না এ জন্য মনিটর করতে হবে। আর যদি কোনো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কিছু না করে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অডিট ফার্মের সঙ্গে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির কার্যকারিতার জন্য সরকারের একটা চ্যাপ্টার রাখতে হবে। কমিটিতে সদস্য কারা এবং সেখানে কী ধরনের অভিযোগ আসছে এসব তদন্তে থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে যারা এর সঙ্গে যুক্ত, তারা বাধ্যতামূলক এসব রিপোর্ট পাঠান। সরকারকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনিটর করে রিপোর্ট পাঠানোর বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেখানে বছরে যৌন হয়রানি-সংক্রান্ত কয়টি অভিযোগ এসেছে এমন তথ্য অডিটের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এতে এ বিষয়ে রিপোর্ট পাওয়া সম্ভব। আর এই রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কোথায় পাঠানো হবে তা সরকার নির্ধারণ করবে। এতে নিচ থেকে ওপরদিকে সোজাসুজি মনিটর করা যাবে। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা ও গাইডলাইন প্রদানের পরও এ ব্যবস্থার দীর্ঘদিন কোনো উন্নতি হয়নি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অকার্যকর যৌন নিপীড়ন কমিটি : দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটিগুলো কাগজে থাকলেও এগুলো দুর্বল হওয়ায় যৌন নির্যাতনের শিকার নারীরা বিচার পাচ্ছেন না। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করা হয়। জানা যায়, ওই ছাত্রী তার এক বন্ধুসহ প্রীতিলতা হলের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দুটি মোটরসাইকেলে করে পাঁচজন এসে তাদের পথ রোধ করে। একপর্যায়ে ভুক্তভোগী ছাত্রীর বন্ধুকে মারধরের পাশাপাশি তাকে উত্ত্যক্ত করা হয়। পরে সেই ছাত্রীকে পাহাড়ের পাদদেশে টেনে নিয়ে যৌন নির্যাতন করে আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করা হয় এবং তাদের কাছ থেকে দুটি মোবাইল ও ৩ হাজার ৭০০ টাকা কেড়ে নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য আশরাফি নিতু বলেন, শুধু সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাটিই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধী যে সেল রয়েছে তাদের কাছে অন্তত আরও চারটি অভিযোগ জমা রয়েছে। কিন্তু যেগুলোর কোনোটিরই বিচার এখন পর্যন্ত হয়নি। ২০০৯ সালে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। কমিটি গঠনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাগিদ দিয়ে আসছে। কিন্তু এত বছর পেরিয়ে গেলেও বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কমিটিকে কার্যকর করা যায়নি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানেনই না যে, সেখানে এ ধরনের কমিটি আছে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যৌন হয়রানি নিরোধ কমিটিতে নিরপেক্ষ তদন্ত করার মতো সদস্য নিয়োগ করা হয় না। আবার দেখা যায় যে, এসব কমিটির নেতৃত্বে যারা থাকেন তারা অভিযুক্ত শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের দ্বারা প্রভাবিত হন। তদন্ত প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে সম্পন্ন না করায় অভিযুক্ত অনেকে বিচার থেকে পার পেয়ে যায়। শুধু কমিটি করে দিলেই হবে না, একে কার্যকর করতে হবে।’

গণপরিবহনে অনিরাপদ নারী : আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপ বলছে, গণপরিবহনে চলাচলকারী ৬৩ শতাংশ কিশোরী, তরুণী ও নারীদের নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। এর মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হন। যৌন হয়রানির শিকার এই নারীদের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক (৪৫ শতাংশ) পরবর্তী সময় মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। এসব যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে গণপরিবহনে ওঠা-নামার সময় চালকের সহকারীর অযাচিত স্পর্শ, বাসে জায়গা থাকার পরও যাত্রীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, বাজেভাবে স্পর্শ করা, ধাক্কা দেওয়া, বাজে মন্তব্য। জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগ নারী ঝামেলা এড়াতে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেননি। জানা যায়, যৌন নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যাত্রীর সংখ্যাই বেশি। গণপরিবহনের চালক ও চালকের সহকারীর হাতেও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন অনেকে। নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়সীর সংখ্যাই বেশি।

অনলাইনেও যৌন হয়রানি : ইন্টারনেটের দুনিয়ায় যৌন হয়রানি, বিকৃত যৌনাচার আর যৌন নিপীড়নের মতো অসংখ্য ঘটনা এখন ঘটছে। যৌন হয়রানির জন্য অপরাধীরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে প্রযুক্তি তথা ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ‘বাংলাদেশে প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে যৌন নিপীড়ন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রযুক্তির অপপ্রয়োগের মাধ্যমে সাইবার স্পেসে যৌন হয়রানি, যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। গবেষণায় দেখা যায়, যৌন নিপীড়নের ক্ষেত্রে ১৫৪ জন ভুক্তভোগীর মধ্যে ৯২ দশমিক ২০ শতাংশই নারী। এর মধ্যে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী ভুক্তভোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি (৫৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ)।

কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি : কর্মজীবী নারী ও কেয়ার বাংলাদেশের এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশের ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হন। কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। সেখানে প্রতি চারজনের একজন যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে এক প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে। ‘তৈরি পোশাকশিল্প কারখানায় নারীশ্রমিকদের যৌন হয়রানি : সংগ্রাম ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে প্রকাশিত গবেষণাটি পরিচালনা করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। এতে বলা হয়, পোশাক কারখানাগুলোতে শতকরা ২২ দশমিক ৪ ভাগ নারীশ্রমিক যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে নারীশ্রমিকদের যে ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় এর মধ্যে কামনার দৃষ্টিতে তাকানো, সংবেদনশীল অঙ্গে কোনো কিছু নিক্ষেপ করা, সংবেদনশীল অঙ্গের প্রতি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানো, হাত বা শরীরের কোনো অংশে স্পর্শ করার মতো ঘটনা বেশি। এ ছাড়া আছে বাজে গালি দেওয়া, অশোভন অঙ্গভঙ্গি, পদোন্নতির কথা বলে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব ইত্যাদি।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর