শিরোনাম
বুধবার, ৩ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপনে বাধা কাটছে

জয়শ্রী ভাদুড়ী

মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপনে বাধা কাটছে

তিন বছর ধরে কিডনি সমস্যায় ভুগছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী সাইদুর হোসেন (৪৮)। প্রতি সপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস করতে হয় তার। ডায়ালাইসিসের খরচ এবং প্রতি সপ্তাহের ভোগান্তিতে অতিষ্ঠ তিনি। সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। প্রতিস্থাপনের খরচ বহনের আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে তার। কিন্তু কিডনি না পাওয়ায় এগোচ্ছে না প্রক্রিয়া। হন্যে হয়ে কিডনি দাতা খুঁজছেন।

এ সমস্যা একজনের নয়। দেশে শুধু দাতা সংকটের কারণে বছরে ৪০ হাজার কিডনি রোগী মৃত্যুর মুখে পড়ে। একজন মরণোত্তর কিডনিদাতার দুটি কিডনি থেকে দুজন রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব। একইভাবে অসংখ্য মানুষ লিভার, হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয় ইত্যাদি রোগে মারা যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিডনি, লিভার বিকল অনেক মানুষ মরণোত্তর অঙ্গদান প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ ক্যাডাভারিক অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট চিকিৎসা নিয়ে নতুন জীবন ফিরে পাচ্ছে। বাংলাদেশের ২০১৮ সালের মানবদেহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যের শরীরে সংযোজনের সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ক্যাডাভারিক অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট প্রক্রিয়া অধরাই থেকে যাচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে গঠন করা হয়েছে ২১ সদস্যের ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্লান্ট কমিটি। আগামী ছয় মাসের মধ্যে ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্লান্ট শুরুর আশা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্লান্ট কমিটির সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ। গতকাল তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্লান্টে ব্রেন ডেথ ডিক্লারেশন করা হয়েছে এমন রোগীর প্রয়োজন হয়। এজন্য একটি কমিটি করে দিয়েছি। কমিটির মাধ্যমে আইসিইউতে থাকা রোগীর স্বজনদের কাউন্সেলিং করা হবে। ব্রেন ডেথ মানে এ রকম রোগী যিনি আইসিইউতে আছেন এবং জীবন ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ রকম রোগীর স্বজনদের কাউন্সেলিং করে যদি বোঝানো যায় যে উনি তো আর বাঁচবেন না, উনার অঙ্গ সংগ্রহ করা যেতে পারে। তাদের রাজি করাতে পারলে লিভার, কিডনি, স্কিন, কর্নিয়াসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে আটজন রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।’ অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। বিদেশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছি, ভারতে যোগাযোগ করেছি। আশা করছি আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমরা ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্লান্ট করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারব। ধর্মীয় নেতাদের বিষয়টি বোঝাতে হবে। সাধারণত এ অঙ্গগুলো মৃত্যুর পর নেওয়া যায় না। শুধু কর্নিয়া মৃত্যুর ছয় ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু অন্য অঙ্গগুলো ব্রেন ডেথ হলে সংগ্রহ করতে হয়। অর্থাৎ রোগীর কৃত্রিম ভেনটিলেশন ও রক্ত সঞ্চালন থাকতে হবে। দেশে অঙ্গ সংযোজন আইন রয়েছে। আমরা সচেতনতা বাড়িয়ে এটাকে প্রচলন করতে চাইছি।’

সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (সিকেডি) হাসপাতালের অধ্যাপক স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত চিকিৎসক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের আইনে মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপনে কোনো বাধা নেই। এজন্য রোগীর স্বজনদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হাসপাতালে প্রয়োজনীয় কাঠামো ও জনবল প্রস্তুত করতে হবে। এ ধরনের রোগী বেশির ভাগ আসে নিউরো সার্জারি বিভাগের আইসিইউতে। যাদের ব্রেন ডেথ হলেও অন্যান্য অঙ্গ সুস্থ রয়েছে এসব রোগীর স্বজনদের মধ্যে সে সচেতনতা থাকতে হবে, বিষয়টি পরিষ্কার বুঝতে হবে। অনেক চিকিৎসকের মধ্যেই এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। দুর্ঘটনায় ব্রেন ডেথ একজন রোগী আমরা পেয়েছিলাম। একজন চিকিৎসকের স্বজন ছিলেন রোগী। কিন্তু কোনোভাবেই আমরা সেই চিকিৎসককে তার স্বজনের মরণোত্তর কিডনি প্রদানে রাজি করাতে পারিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিডনি সংগ্রহ করে রক্তের মতো ব্যাংকে রাখা যায় না। রোগীর কাছ থেকে সংগ্রহ করে ১২ থেকে সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিস্থাপন করতে হয়। লিভার, হার্ট এসব অঙ্গও রাখা যায় না। এজন্য সার্বক্ষণিক একটি বিশেষজ্ঞ টিমের এ কাজ করতে হবে। এমন রোগী কখন আসবে তা তো আর নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বারডেমের মতো বড় হাসপাতালে এ ধরনের রোগী বেশি আসে। কিডনি সংগ্রহ হলে প্রতিস্থাপন করার জন্য বিভিন্ন বিভাগের ডাক্তারের সমন্বয়ে টিম করে অপারেশন থিয়েটার প্রস্তুত করতে হবে। মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপনে সার্বক্ষণিক কর্মরত চিকিৎসকদের সুরক্ষা এবং প্রণোদনার বিষয়ে ভাবতে হবে। নিরলস পরিশ্রম করে সুনামের জায়গায় চিকিৎসকদের যেন অপমানিত হতে না হয়। আমাদের হাসপাতালে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৪৪ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন করতে পারলে অনেক কিডনি রোগী জীবন ফিরে পাবে।’ কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের ডায়ালাইসিস বিভাগের চিকিৎসক ডা. শেখ মইনুল খোকন বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন প্রচলিত রয়েছে। ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বহু দেশে মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আমাদের দেশে মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপনে জোর দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশে ২ কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। প্রতি বছর ৪০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হয়। এর মধ্যে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নিতে পারে। বাকি ৭৫ শতাংশ রোগী চিকিৎসাসেবার বাইরে থাকে। প্রতিদিন কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করানো হয় ৩০০ রোগীর। হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৫০০ এবং জরুরি বিভাগে ১০০ কিডনি রোগী সেবা নেন। কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হলে রক্তের গ্রুপ, টিস্যুসহ বেশ কয়েকটি বিষয় মিলিয়ে দেখতে হয়। রক্তের গ্রুপ মিললে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে প্রতিস্থাপনে খরচ হয় ২ লাখ টাকা। রক্তের গ্রুপ না মিললে কিডনি প্রতিস্থাপনে সর্বোচ্চ ৮ লাখ টাকা খরচ হয়। এ পর্যন্ত কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ৫৫৩ জনের কিডনি সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন হলে বিপুলসংখ্যক রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব।’

সর্বশেষ খবর