বুধবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

উচ্চ বেতনের লোভ দেখিয়ে পাচার কম্বোডিয়ায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভনে কম্বোডিয়ায় মানব পাচার করত এ চক্রটি। একেকজনের কাছ থেকে ৪-৫ লাখ টাকা নিয়ে কম্বোডিয়ায় ২ থেকে ৩ হাজার ডলারে বিক্রি করে দেওয়া হতো। ব্যবহার করা হতো সাইবার প্রতারণার কাজে। ছিনিয়ে নেওয়া হতো পাসপোর্ট। মানব পাচারকারী চক্রের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত ও সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার অনেকে। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে গতকাল ভোররাতে রাজধানীর পল্টন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চক্রের মূলহোতাসহ তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তারা হলেন- কম্বোডিয়ায় মানব পাচার চক্রের মূলহোতা নাজমুল ইসলাম (৩০), নূর ইসলাম সাজ্জাদ (২৫), মো. সিরাজুল ইসলাম পঞ্চায়েত (৫৭)। এ সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি পাসপোর্ট, চারটি মোবাইল সেট, ১টি রেজিস্টার, মানব পাচার সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র জব্দ করা হয়। চক্রটি এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৫ শতাধিক মানুষকে উচ্চ বেতনের চাকরির ফাঁদে ফেলে কম্বোডিয়ায় পাচার করেছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ চক্রের মূলহোতা কম্বোডিয়া প্রবাসী নাজমুল ইসলাম। বিদেশগামীদের কম্বোডিয়া প্রবাসী আলীম ও শরিফুলের সহায়তায় কম্বোডিয়ান ট্যুরিস্ট ই ভিসা করা হয়। তারপর বিমানযোগে কম্বোডিয়ায় পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, কম্বোডিয়ায় যাওয়ার পর নাজমুল তার সহযোগী কম্বোডিয়া প্রবাসী রাকিব ও রফিকের সহায়তায় প্রথমে ভুক্তভোগীদের কম্বোডিয়া প্রবাসী আরিফের হোটেলে নিয়ে যায় এবং তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ওই হোটেলে কিছু দিন অবস্থান করার পর তাদের কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য কম্বোডিয়া প্রবাসী কামাল ওরফে লায়ন কামাল ও আতিকের সহায়তায় একটি বিদেশি ট্রেনিং সংস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিদেশি প্রশিক্ষকরা ভিকটিমদের গুগল ট্রান্সলেটরের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছদ্মনামে অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করে অন্যদের কীভাবে প্রতারণা করা যায়, ভুয়া ক্লোন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা আত্মসাৎ করার কৌশল, ভুয়া নম্বর থেকে ফোন দিয়ে বা চ্যাটিং করে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার নাম করে কৌশলে ডিপোজিট হাতিয়ে নেওয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভয়েস কল ও ভিডিও কল রেকর্ডিং করে পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেল করে অর্থ আত্মসাৎ করার কৌশল শেখানো হয়। মানব পাচারকারীদের ভাষায়, সাইবার প্রতারণার বিষয়টি স্ক্যামার হিসেবে পরিচিত বলে জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা। এক প্রশ্নের উত্তরে লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তরুণ-তরুণীদের নিয়ে সাইবার ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ভুক্তভোগীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হতাশাগ্রস্ত অপেক্ষাকৃত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের টার্গেট করতে বলা হয়। আবার কখনো বিভিন্ন দেশ থেকে স্থানীয় লোকদের সহায়তায় যেসব ব্যক্তি ব্যাংক বা এনজিও থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন বা ঋণ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট নম্বর বা মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করা হয়। তারপর তাদের চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে কম সুদে আকর্ষণীয় ঋণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাবে রাজি হলে ডিপোজিট বাবদ ৫ শতাংশ অর্থ মোবাইল ব্যাংকিং বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করতে বলা হয়। এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করার পর ওই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিদেশি চক্রটি এভাবে ৬ থেকে ৭ মাস একটি ক্যাসিনো বা প্ল্যাটফরম চালিয়ে যাওয়ার পর ঠিকানা, ফেক অ্যাকাউন্ট, ডোমেইন ও ডিভাইস পরিবর্তন করে থাকে। এভাবে একটি প্ল্যাটফরমে একজন ভুক্তভোগীকে বিরতিহীন ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা কম্পিউটারে কাজ করতে হয়।

তিনি বলেন, কেউ পাচার চক্রটির টার্গেট সংগ্রত করতে ব্যর্থ হলে বা কাজ করতে না চাইলে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হতো। এমন কি খাওয়া-দাওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হতো। কেউ চলে আসতে চাইলে তাকে যত ডলার দিয়ে ক্রয় করা হয়েছে তার দ্বিগুণ অর্থ ফেরত চাওয়া হতো। তখন ভুক্তভোগীরা বাধ্য হয়ে দেশ থেকে টাকা নিয়ে ওই কোম্পানিতে দিয়ে মুক্তি পেতে কম্বোডিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি দালালদের আশ্রয়ে এলে তাদের পুনরায় আরেকটি সাইবার প্রতারক কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হতো। এ চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা করা হয়েছে বলে জানান র‌্যাব-৩ অধিনায়ক।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর