রবিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

দাপট শুধু বেসরকারি বাসের

শিমুল মাহমুদ

দাপট শুধু বেসরকারি বাসের

প্রায় ২ কোটি মানুষের মেগাসিটি ঢাকায় সরকারের হাতে গণপরিবহনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের যাতায়াতে রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের ভূমিকা খুবই নগণ্য। ফলে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থার ক্রীড়নক হয়ে উঠেছে। সরকারি বাসের সেবা ক্রমেই সীমিত হয়ে পড়েছে। নিত্যদিনের যাতায়াতে সাধারণ মানুষ নির্ভরতার বদলে জিম্মি হয়ে আছে বেসরকারি খাতের কাছে। ফলে, চরম স্বেচ্ছাচারিতা চলছে সিটি বাস সার্ভিসে। ভাড়ার নামে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে গণপরিবহন। সরকার যাত্রী স্বার্থ রক্ষায় কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না। উপরন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বেসরকারি খাতের বাস মালিক-শ্রমিকরা সরকারি বিআরটিসির বাস বন্ধের জন্য আন্দোলন করছে। অনেক স্থানে বিআরটিসি বাস চলাচলে বাধা দিচ্ছে তারা। অথচ সারা দেশে বিআরটিসির বাসের সংখ্যা রাস্তায় চলাচলকারী মোট বাসের তুলনায় ১ শতাংশেরও কম। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিটি সার্ভিসে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। কঠোর তদারকির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সড়ক পরিবহন সংস্থা বিআরটিসিকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে এর মাধ্যমে যাত্রীসেবা বিস্তৃত করা প্রয়োজন। বর্তমানে বিআরটিসির বহরে ১ হাজার ৬০০ বাসের সংখ্যা থাকলেও কাজীর গরুর মতো গোয়ালে পাওয়া যায় না সব বাস। প্রায় এক চতুর্থাংশ বাস চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গ্যারেজবন্দি হয়ে আছে। সারা দেশে ১ হাজার ১০০-এর কিছু বেশি বাস নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রাস্তায় চলাচল করে। এর মধ্যে ঢাকায় চলছে প্রায় ৪০০ বাস। তার মধ্যেও প্রায় ১৫০ বাস দীর্ঘমেয়াদি লিজে দেওয়া হয়েছে শিক্ষাঙ্গনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। বিআরটিসি যেন এখন ভাড়া খাটা কোম্পানি। রাস্তায় তাদের যে বাস চলছে সেগুলো বেসরকারি বাসের তুলনায় ভগ্নাংশ মাত্র। ফলে যাত্রী সেবায় উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না সরকারি সংস্থা বিআরটিসি। বিশ্বের উন্নত সমৃদ্ধ সব রাষ্ট্রেই নগর পরিবহন সেবা থাকে সরকারি সংস্থার নিয়ন্ত্রণে। যাত্রীরা সাশ্রয়ী    মূল্যে সরকারি গণপরিবহনের সেবা নিতে পারেন। কিন্তু অর্ধশত বছর আগে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে তার ঠিক উল্টো চিত্র। ভাড়া নির্ধারণ থেকে সড়ক পথ নিয়ন্ত্রণ সবকিছুতেই বেসরকারি খাতের দাপট। ফলে যাত্রী চাহিদার নিরিখে রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস, কাউন্টার সার্ভিস, ওয়েবিল প্রথাসহ নানা পদ্ধতি চালু করেছে বাস কোম্পানিগুলো। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ সিটিং সার্ভিস, ওয়েবিল প্রথা বাতিলে একাধিকবার উদ্যোগ নেন। কিন্তু মালিক সমিতির বিরোধিতা এবং বিআরটিএর অভিযানের মধ্যেও সিটিং সার্ভিস, ওয়েবিল প্রথা চলছে। সরকারি রেটের তোয়াক্কা না করে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে নিজেদের রেটে। রাজধানীর সড়কে সরকারি পরিবহনের কার্যকর উপস্থিতি থাকলে বেসরকারি খাতের এমন দৌরাত্ম্যের অবসান হতো। এদিকে সরকারি সংস্থা বিআরটিসিকে চলতে দিচ্ছে না বেসরকারি পরিবহন মালিকরা। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় পরিবহন মালিক নেতারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় দেশের বিভিন্ন রুটে বিআরটিসি বাস চলাচলে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বাসে যাত্রী ওঠানামা করতে দিচ্ছে না। এমনকি প্রশাসনের সামনেই বাস আটকে রাখছেন। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। সেই সুযোগে কমছে বিআরটিসি বাসের সংখ্যা। অন্যদিকে বেড়েই চলছে পরিবহন খাতের নৈরাজ্য।

গত ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরই দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের ২৩ রুটে বাস চালুর চাহিদা বেড়ে যায়। এই বাড়তি চাহিদার কথা বিবেচনা করে বিআরটিসি তাদের ১১টি ডিপো থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে এসি/ননএসি মিলিয়ে ৫৩টি বাস চালু করে। এসব বাস বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় মালিক সমিতি এবং পরিবহন কর্মীদের বাধায় পড়ছে। তারা বিভিন্ন স্থানে বিআরটিসির গাড়ি আটকে রাখছে। চলাচলে বাধা দিচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের সর্বত্র চলাচলের অনুমতি থাকলেও সরকারি সংস্থা বিআরটিসির বাস চালাতে প্রয়োজন হচ্ছে বেসরকারি পরিবহন মালিক সমিতির অনুমতি। নইলে যাত্রীসহ বাস আটকে দিচ্ছেন তারা। প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটছে। শুধু দক্ষিণাঞ্চলই নয়, দীর্ঘদিন ধরেই বিআরটিসি বাস চলাচলে বাধা দিচ্ছেন বেসরকারি পরিবহন মালিকরা। বিআরটিসি বাস, ডিপো ভাঙচুরসহ স্টাফদের মারধরের ঘটনা ঘটছে অহরহ। ৯ আগস্ট রাজধানীর গুলিস্তান থেকে ফরিদপুরের বোয়ালমারী রুটে চালু হয় বিআরটিসি বাস। বাসটি পদ্মা সেতু হয়ে নিয়মিত চলাচলের কথা। একদিন পর বাসটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে ছেড়ে এলে ভাঙ্গা এলাকায় বাধা দেন ফরিদপুর বাস মালিক সমিতির নেতারা। এ সময় বাসের স্টাফ ও চালককে মারধরের হুমকি এবং যাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণ করে তাদেরকে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এতে বন্ধ হয়ে যায় বোয়ালমারী-ঢাকা রুটে শুরু হওয়া বিআরটিসি বাস চলাচল।

রাজধানীর সড়কে বেসরকারি বাসের ছড়াছড়ি

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, বিআরটিসির বাস বন্ধ করার কারও কোনো এখতিয়ার নেই। সংস্থাটির ১৯৬১ সালের আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের যে কোনো সড়কে বিআরটিসি বাস চলতে পারবে। এ জন্য রুট পারমিট কিংবা অন্য কোনো কাগজপত্রের প্রয়োজন হবে না।

এদিকে গণপরিবহন হিসেবে সাধারণ যাত্রীদের সেবা চেয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টাফ বাসের সার্ভিসেই বেশি মনোযোগী বিআরটিসি। ঢাকায় ৪১৩টি বাসের মধ্যে ১৬০টির বেশি বাস চলছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদি লিজে। সংস্থাটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম দুর্নীতি বাসা বেঁধে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বিআরটিসি। রাজধানীর গণপরিবহন নৈরাজ্যের মধ্যে যাত্রীদের ভরসা হতে পারত রাষ্ট্রায়ত্ত এই পরিবহন সংস্থা। কিন্তু অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং অনিয়মের কারণে বিআরটিসি সেই ভূমিকা রাখতে পারেনি। অবহেলা আর কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশ বাসই প্রত্যাশিত মেয়াদ পর্যন্ত সেবা দিতে পারছে না। সরকারি এ সংস্থার মোট বাসের প্রায় এক-চতুর্থাংশের বেশি অচল পড়ে আছে। যাতে বিআরটিসির অধিকাংশ ডিপোই পরিণত হয়েছে নষ্ট গাড়ির ভাগাড়ে। লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হওয়া বিআরটিসির বর্তমান চেয়ারম্যান সরকারের অতিরিক্ত সচিব মো. তাজুল ইসলাম সংস্থাটিতে কিছু পদ্ধতিগত পরিবর্তন এনে খাদের কিনার থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করছেন। এদিকে সিটি পরিবহনে বেসরকারি পরিবহন কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম্য বন্ধ করার উদ্যোগ হিসেবে প্রায় ৯ মাস আগে ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৫০টি বাস নিয়ে চালু হয় ঢাকা নগর পরিবহন। বাস রুট রেশনালাইজেশন নামের এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাজধানীর বিশৃঙ্খল গণপরিবহন খাত শৃঙ্খলায় আনতে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুটে ৫০টি বাস নিয়ে চালু হওয়া এই সার্ভিস নয় মাস পরও সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। ব্যাপক চাহিদা থাকলেও নানা অব্যবস্থাপনায় এই রুটে যাত্রীদের স্বস্তির বদলে দুর্ভোগ বেড়েছে। ৫০টি বাস নিয়ে চালু হওয়া এই রুটে এখন বাস চলছে ৪০টির মতো। বাসের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে ১০০ হওয়ার কথা থাকলেও উল্টো কমেছে। একই রুটে চলা অন্য পরিবহনগুলো অভিযানে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা। এতে যাত্রীসেবার বদলে বেড়েছে দুর্ভোগ। এমন পরিস্থিতিতে আরও তিনটি রুটে নগর পরিবহনের বাস চালুর কথা থাকলেও সেটি এখনই হচ্ছে না।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও বিআরটিসির সাবেক পরিচালক (কারিগরি) ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, বিআরটিসি সরকারের সংস্থা। এই বাস দেশের যে কোনো সড়কে যখন তখন চলতে পারে। কোনো রুট পারমিটের প্রয়োজন নেই। বর্তমানে আমাদের দেশে বিআরটিসি বাসের সংখ্যা ১ শতাংশের চেয়ে কম। মালিক সমিতির বাসের সংখ্যাই বেশি। এ জন্য বিআরটিসি বাসগুলোকে চলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। জনগণ বিআরটিসি বাসে অল্প খরচে চলতে চায়। সরকারের উচিত দ্রুত সময়ে এই বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। তাহলে জনগণ যাতায়াত সুবিধা পাবে। মালিক সমিতির লোকজন সরকারি বাস কিংবা বিআরটিসি বাস চলাচলে বাধা দিতে পারে না। যে করছে সেটি বেআইনি। বিআরটিসির বাস বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

সর্বশেষ খবর