মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ভাষাসৈনিক সাংবাদিক রণেশ মৈত্র আর নেই

পাবনা প্রতিনিধি

ভাষাসৈনিক সাংবাদিক রণেশ মৈত্র আর নেই

ভাষাসৈনিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবদিক ও কলামিস্ট, পাবনা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা রণেশ মৈত্র আর নেই। গতকাল ভোরে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। সম্প্রতি তিনি মফস্বল সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখায় ‘বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ পাবনায় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। পাবনা প্রেস ক্লাবের সম্পাদক সৈকত আফরোজ আসাদ রণেশ মৈত্রের পরলোকগমনের খবর নিশ্চিত করে জানান, তাঁর ছেলে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরার পর পারিবারিক সিদ্ধান্তে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রণেশ মৈত্র ১৯৩৩ সালের ৪ অক্টোবর রাজশাহীর নহাটা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ভুলবাড়িয়া গ্রামে। বাবা রমেশ চন্দ্র ছিলেন প্রাথমিকের শিক্ষক। সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পরই রণেশ মৈত্র টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন। আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়েই ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৫৫ সালে আইএ ও ১৯৫৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫১ সালে সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘নওবেলাল’ পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু। এরপর কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সত্যযুগে তিন বছর কাজ করেন। পরে ১৯৫৫ সালে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৬১ সালে ডেইলি মর্নিং নিউজ এবং ১৯৬৭ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত দৈনিক অবজারভারের পাবনা প্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৯২ সালে দি নিউ নেশনের মফস্বল সম্পাদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দি ডেইলি স্টারের পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। পরে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়ে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লিখে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। এদিকে ১৯৬১ সালে পাবনায় পূর্ব পাকিস্থান মফস্বল সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সম্মেলনের মাধ্যমে মফস্বল সাংবাদিকরা তাঁদের পেশার স্বীকৃতি পান। সে বছরই প্রতিষ্ঠিত পাবনা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নির্বাচিত হন রণেশ মৈত্র। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। ১৯৪৮ সালে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় রণেশ মৈত্রের রাজনৈতিক জীবন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জেলও খেটেছেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে রণেশ মৈত্র পাবনা জেলার অন্যতম সংগঠক ছিলেন। সে বছরই ছাত্র ইউনিয়নের জেলা সভাপতি ও ১৯৫৩ সালে এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ অবজারভারের আবদুল মতিন, কামাল লোহানীসহ প্রগতিশীল বন্ধুদের সঙ্গে গঠন করেন ‘শিখা সংঘ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। ভাষা আন্দোলন, ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনসহ পাক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় রণেশ মৈত্র বহুবার কারাবরণ করেন। ১৯৫৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তবে ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপে ও ১৯৬৭ সালে মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপে যোগ দেন। দীর্ঘদিন ন্যাপের প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রণেশ মৈত্র। বর্তমানে তিনি ‘ঐক্য ন্যাপ’-এর প্রেসিডিয়াম সদস্য ও পাবনা জেলা সভাপতি। কর্মজীবনে সফল আইনজীবী হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে পরে সেখান থেকেও স্বেছায় অবসর নেন। রণেশ মৈত্রের স্ত্রী পূরবী মৈত্র বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পাবনা জেলা সভাপতি। চার ছেলেমেয়ের সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘রুদ্র চৈতন্যে বিপন্ন বাংলাদেশ’ পাঠকমহলে ব্যাপক সমাদৃত। এ ছাড়া তাঁর প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ ‘নিঃসঙ্গ পথিক’ তাঁর জীবনের ওপর বিভিন্ন জনের এক বর্ণিল চিত্রগাঁথা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর