মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

উচ্চ বেতনের প্রলোভনে দুবাই পাচার করত ওরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কুষ্টিয়ার চার যুবককে দুবাই পাচার করেছিল একটি চক্র। তারা ওই দেশের ফুটপাত, পার্ক ও সমুদ্রের তীরে প্রায় দুই সপ্তাহ মানবেতর জীবন যাপন করেন। সহ্য করতে হয় দালালদের নির্যাতন। পরে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে পরিবার তাদের দেশে ফেরত নিয়ে আসে। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ভুক্তভোগী চার যুবকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে চার মানব পাচারকারীকে গ্রেফতার করেছেন র‌্যাব-৩-এর সদস্যরা। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- তোফায়েল আহমেদ, আক্তার হোসেন, আনিছুর রহমান ও মো. রাসেল। তাদের কাছ থেকে ১৬টি পাসপোর্ট, তিনটি চেকবই, চারটি স্ট্যাম্প, পাঁচটি মোবাইল ফোন, চারটি বিএমইটি কার্ড ও চারটি রেজিস্টার উদ্ধার করা হয়েছে। রবিবার রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও ঢাকার গুলশান থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে মানব পাচার চক্রের অন্যতম হোতা তোফায়েল দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বেকার যুবকদের টার্গেট করেন। এরপর সহযোগীদের মাধ্যমে তাদের দুবাই পাচার করে টাকা আত্মসাৎ করেন। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।

দুবাইয়ে পাচারের শিকার মো. মজনু হোসেন বলেন, ‘আমার বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর। অনলাইনে তোফায়েলের সঙ্গে চলতি বছর জুনে পরিচয় হয়। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে জানতে পারি তিনি বিদেশে লোক পাঠান। এরপর আমিসহ কয়েকজন তার সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাদের দুবাই পাঠানোর কথা বলে ঢাকার পল্টন এলাকার একটি অফিসে বসিয়ে টাকা ও পাসপোর্ট নিয়ে নেন। আমি ছাড়াও দৌলতপুরের মহরম, ফাহিম রেজা ও হেলাল পাসপোর্ট দেন।’ তারা কয়েক দফায় দালালদের ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা করে প্রত্যেকে দিয়েছেন। কোনো মেডিকেল ছাড়াই ফাহিম ও মহরমকে ৫ আগস্ট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে আসে ওই চক্র। তখনো তাদের কাছে পাসপোর্ট দেয়নি। বিমানবন্দরে প্রবেশ করানোর পর পাসপোর্ট দেয়। এরপর তারা দুজন দুবাই যান। মজনু বলেন, ‘৬ আগস্ট আমি ও হেলাল দুবাই যাই। দুবাইয়ে জাহিদ নামে একজন আমাদের রিসিভ করেন। দুবাইয়ে নেওয়ার পর আমাদের একটি বাড়িতে আটকে রাখেন জুয়েল ও জাহিদ। এরপর চাকরি চাইলেই আমাদের নির্যাতন করা হয়। তারা আমাদের কাছ থেকে হাতখরচের টাকাও নিয়ে নেন।’ একদিন এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে আটকে রাখার জন্য নেওয়ার সময় পালান চার যুবক। এরপর তারা দুবাইয়ের ফুটপাত, ক্যাফেটেরিয়া, পার্ক ও সমুদ্রের তীরে প্রায় দুই সপ্তাহ ছিলেন। একপর্যায়ে এক বাংলাদেশির সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। তার কাছে কাজ চাইলে তিনি জানান, ভ্রমণ ভিসায় তারা কোনো কাজ পাবেন না। এরপর বাড়ি থেকে টিকিটের টাকা এনে তারা দুবাই থেকে ৫ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরেন। ভুক্তভোগী মহরম বলেন, ‘আমরা দুই সপ্তাহের বেশি খোলা আকাশের নিচে ছিলাম। মানুষের কাছে চেয়ে খেয়েছি। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে কোনোরকম প্রাণ বাঁচিয়েছি।’ বাংলাদেশে ফিরে ভুক্তভোগী তিন যুবক অভিযোগ করলে ওই চার দালালকে গ্রেফতার করা হয়। র‌্যাব বলছে, দুই বছরে চক্রটি মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শতাধিক ব্যক্তিকে পাচার করেছে। তারা সবাই বিদেশে গিয়ে কাজ না পেয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকারসহ আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে দেশে ফিরে এসেছেন এবং অনেকেই এখনো বিদেশে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। লে. কর্নেল আরিফ বলেন, দুবাইপ্রবাসী জাহিদ স্বাগত জানিয়ে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যান ভুক্তভোগীদের। পরে তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও নগদ অর্থ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তারপর তাদের একটি সাজানো কোম্পানিতে চাকরি দেওয়া হয়। চার-পাঁচ দিন পর ওই কোম্পানি থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, আইনি জটিলতার কারণে কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তারপর জাহিদ পুনরায় ভুক্তভোগীদের অজ্ঞাত স্থানে বন্দি করে রাখেন। পরে ভুক্তভোগীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে অর্থ আদায় করেন। ভুক্তভোগীদের সেখানে খাবারও দেওয়া হয় না। খাবার চাইলে জাহিদ বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়ে এসে খাবার কিনতে বলেন। এ সময় তোফায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ভুক্তভোগীদের অপেক্ষা করতে বলেন। তিনি জানান, আইনি জটিলতা দূর হলেই আবার কোম্পানি চালু হবে। তখন তারা বেতন ও কাজের সুযোগ পাবেন। ভুক্তভোগীরা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকে নিজ চেষ্টায় টিকিট জোগাড় করে দেশে চলে আসেন। তখন জাহিদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ফেরত নিতে হলে ভুক্তভোগীদের ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। র‌্যাব কর্মকর্তা আরিফ জানান, তোফায়েল এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। তার বাবা ২৪ বছর ধরে দুবাই শিল্পাঞ্চল এলাকায় হোটেলের ব্যবসা করছেন। ২০১৭ সালে তিনি দুবাই গিয়ে বাবাকে হোটেল ব্যবসায় সহায়তা করতে থাকেন। মহামারি করোনা শুরু হলে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ওই সময় তার কোনো উপার্জন না থাকায় পরিচিত দুবাইপ্রবাসী জাহিদের মাধ্যমে তিনি মানব পাচারে জড়িয়ে পড়েন। তোফায়েল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালু করেন। কিন্তু ওই এজেন্সির কোনো লাইসেন্স ছিল না। তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে দুবাইয়ে যাতায়াত করার ফলে নিজেদের প্রয়োজনে তাদের বিভিন্ন ট্রাভেল ও রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে পরিচয় ছিল। এ ছাড়া দুবাইপ্রবাসী জাহিদ দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। জাহিদের মাধ্যমে তোফায়েলের আনিছুর ও আক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের মাধ্যমেই রাসেলসহ অন্য দালালদের সঙ্গে তোফায়েলের পরিচয় হয়। জাহিদ দুবাই থেকে ভ্রমণ ভিসা তৈরিতে ওই চক্রকে সহায়তা করে থাকেন। তোফায়েল নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করতেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর