পঞ্চগড়ের করতোয়ায় নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ তিনজনের সন্ধানে গতকালও অভিযান চালানো হয়েছে। ওই ঘটনায় এ নিয়ে টানা সাত দিন অভিযান চালানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিনজনের লাশ না পাওয়া পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চলবে। এদিকে নিহতদের জন্য সপ্তমীতে সারা দেশে বিশেষ প্রার্থনার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় পূজা উদযাপন পরিষদ।
এ বছর শারদীয় দুর্গাপূজার আনন্দ নেই পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ বোদা উপজেলার করতোয়া পাড়ের হিন্দুদের মাঝে। এ এলাকায় বিরাজ করছে শোকের ছায়া। প্রতিটি মন্ডপে টাঙানো হয়েছে শোকের ব্যানার। অনাড়ম্বর দুর্গাপূজা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জেলার ২৯৫টি পূজামন্ডপে।
নৌকাডুবিতে স্বজনদের হারিয়ে দিশাহারা মা দুর্গার এখানকার ভক্তকুল। আয়োজকরা বলছেন, বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানিতে আমরা শোকাহত।পঞ্চগড় জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিপেন চন্দ্র রায় জানান, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি ওই নৌকাডুবিতে নিহতদের শান্তি কামনায় শারদীয় দুর্গোৎসবের সপ্তমীর দিনে দেশের পূজামন্ডপগুলোয় বিশেষ প্রার্থনা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই দিন সকালে অঞ্জলি শেষে সারা দেশে একযোগে এই বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
তিনি আরও জানান, নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পঞ্চগড় জেলার ২৯৫টি পূজামন্ডপে অনাড়ম্বর দুর্গাপূজা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পূজামন্ডপে আগেই যতটুকু সাজসজ্জা করা হয়েছিল, তা সেখানেই থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাঁকজমকপূর্ণ আলোকসজ্জা ও অতিরিক্ত গানবাজনা পরিহার করা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্গাপূজা চলাকালে কালো ব্যাজ ধারণ এবং মন্ডপগুলোয় শোক ব্যানার টাঙানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মাকে খুঁজছে তিন বছরের ধীর-অরণ্য : তিন বছর বয়সী ধীর, মলিন মুখ নিয়ে ছটফট করছে, বাড়ির এখানে-সেখানে ছুটে বেড়াচ্ছে। তার চোখে-মুখে অপেক্ষার বিরক্তি। মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে সে। কখন আসবে মা। তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যায়। পাঁচ বছর বয়সী মহানন্দ এতদিনে বুঝে ফেলেছে তার মা আর কোনো দিন আসবে না। তারা দুই ভাই এখন দাদি নানি আর বাবার কাছে থাকছে। বাবা কার্তিক রায় জানান, প্রতিদিন রাতে ছেলেটা মার কাছে যেতে চায়। এপাশ-ওপাশ করে। দুধ খেতে চায়। আমি তাকে বলি তোমার মা বেড়াতে গেছে। কাল সকালে আসবে। ছত্রশিকারপুর গ্রামে মহানন্দদের বাড়ি। মহালয়ার দিনে নতুন কাপড়চোপড় পরে মায়ের সঙ্গে বদেশ্বরী মন্দিরে পূজা দেখতে যাচ্ছিল ধীর। নৌকাডুবিতে মা লক্ষ্মীরানী ডুবে যান করতোয়ার জলে। কার্তিক রায়ের পরিবার থেকে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় সে। একইভাবে দাদির কোলে চড়ে সর্বক্ষণ মাকে খুঁজছে তিন বছরের অরণ্য। তার বাবা বাসুদেব শোকে স্তব্ধ। বাসুদেব জানান, ছেলের কান্না সহ্য করতে পারছি না। এখনো মায়ের দুধ ছাড়েনি। কীভাবে কী করব কোনো দিশা নেই। নৌকাডুবিতে নিহতদের মধ্যে ৩১ জন নারী ও ১৮ পরিবারের ২১ শিশু। অন্যদিকে সন্তান হারানোর বেদনায় কেঁদেই চলেছেন মায়েরা। আদরের শিশুরা নেই তাদের কোলে। কোনো দিন মা বলে ডাকবে না আর। গুরুগোবিন্দপুর গ্রামের প্রতিমা রায় হারিয়েছেন দুই মেয়ে। কবিতা রানী (১১) আর পুতুল রানী (১৪)। শুক্রবার দুই মেয়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান শেষ করা হয়েছে। নৌকাডুবির ঘটনায় ১৮ পরিবারের ২১ শিশু প্রাণ হারিয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায় বলেন, তদন্ত কমিটির সদস্যরা নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান, মৃতদেহ উদ্ধার এবং পরিবারকে বিভিন্ন সহায়তা প্রদানে সক্রিয় রয়েছে। ২৫ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৬৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। এর ৬৮ জনই হিন্দু ধর্মের। এ ছাড়া নিখোঁজ তিনজনও হিন্দু ধর্মের।