বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

দুর্বল সংগঠন নিয়েও রংপুরে শক্ত প্রস্তুতি বিএনপির

শফিউল আলম দোলন ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

দুর্বল সংগঠন নিয়েও রংপুরে শক্ত প্রস্তুতি বিএনপির

অপেক্ষাকৃত দুর্বল সংগঠন নিয়েও আগামী শনিবার রংপুরে গণসমাবেশ সফল করতে শক্ত প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। এতে তিনটি বিভাগে অনুষ্ঠিত সমাবেশের চেয়ে আরও বেশি লোক সমাগমের আশা করছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা। প্রস্তুতি কমিটির কার্যক্রমও প্রায় শেষ পর্যায়ে।

বিগত জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলসহ রংপুরের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির আধিক্য থাকলেও সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিএনপি তার সাংগঠনিক এই দুর্বলতা অনেকটাই কাটিয়ে উঠছে বলে মনে করছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, সেই রাজনৈতিক অবস্থা রংপুরে এখন আর নেই।

নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে মানুষ চরম ক্ষুব্ধ। মঙ্গা-পীড়িত ‘খ্যাত’ এলাকা রংপুরের মানুষের অবস্থা দিনকে দিন আরও খারাপ হয়ে উঠছে। বাড়ছে দরিদ্রতা। ফলে এলাকার মানুষ সরকারের ওপর চরমভাবে অসন্তুষ্ট। আর এই সুযোগটিই নিচ্ছেন বিএনপি নেতারা। মানুষকে নানাভাবে বুঝিয়ে- শুভ দিনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে রংপুর বিভাগীয় গণসমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, এই বিভাগের ১০টি সাংগঠনিক জেলার অধিকাংশই সফর শেষ করেছেন তিনি। এতে দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থক ছাড়াও সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে তারা ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন। বিশেষ করে সর্বস্তরে দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী উত্থানের বিষয়টি সাধারণ মানুষের মনে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে। কারণ সাধারণ মানুষ আর কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

ডা. জাহিদ আরও বলেন, ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে যত বাধা-বিপত্তিই আসুক না কেন- রংপুরের সমকালীন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণসমাবেশটিই হবে ২৯ অক্টোবর। বাধা দিলে বরং মানুষ আরও ফুঁসে উঠবেন। প্রত্যাশার চাইতেও বড় হবে বিএনপির এই সমাবেশ। তাঁর প্রত্যাশা- গণসমাবেশ নির্ধারিত কালেক্টরেট ময়দান (ঈদগাহ মাঠ)সহ পার্শ্ববর্তী টেনিস মাঠ পূর্ণ হয়ে আশপাশের চতুর্দিকে দেড় থেকে দুই কিলোমিটার সড়ক পর্যন্ত জনসমাগম হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৬ অক্টোবর ছিল জেলা কমিটির নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় সভা। সে অনুযায়ী এই বিভাগের প্রতিটি জেলা থেকে শুরু করে উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়নসহ ওয়ার্ড, এমনকি পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত প্রতিটি ইউনিটে দল ও অঙ্গসংগঠনের প্রস্তুতি সভা ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। পঞ্চগড় থেকে শুরু করে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ পর্যন্ত পুরো বিভাগজুড়ে প্রতিটি ইউনিটের প্রস্তুতি সভাতেই এবার ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ মানুষ অংশ নিয়েছেন। তারা সবাই গণসমাবেশে অংশ নেওয়ার একান্ত আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও তাদের কর্মী, সমর্থক ও অনুসারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাবেশে অংশ নেবেন বলে বিএনপিকে জানিয়েছেন। বিএনপি রংপুর জিলা স্কুল মাঠ চেয়ে আবেদন করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত কালেক্টরেট ময়দান তথা জেলা ঈদগাহ মাঠে সমাবেশের মৌখিক অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় নেতারা বলছেন, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনায় বিভাগীয় গণসমাবেশে এত বাধা-বিপত্তির পরও যখন এত লোক সমাগম হয়েছে, সুতরাং রংপুরে তার চেয়েও বেশি মানুষ হবে বলে তারা আশা করছেন। বিশেষ করে ঘোষিত কিংবা অঘোষিতভাবে সব ধরনের পরিবহণ ধর্মঘট আসার বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত বলেই ধরে নিয়েছেন তারা। তার সঙ্গে রয়েছে পথে পথে ক্ষমতাসীনদের হামলা ও বাধা প্রদানের বিষয়টি। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব ধরনের বাধা-বিপত্তির কথা মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা।

‘রংপুরকে সাধারণত জাতীয় পার্টির ঘাঁটি বলেই অনেকে মনে করেন, সেক্ষেত্রে বিএনপির এই সমাবেশ কতটুকু সফল হবে বলে আশা করেন?’ এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সেই দিন আর এখন নাই। রংপুরকে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির দুর্গ আর বলা যাবে না। একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। সেখানে বিএনপি এখন অনেক বেশি শক্তিশালী ও অনেক বেশি জনপ্রিয়। অন্য বিভাগের মতো সেখানেও জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাবেশে অংশ নেবেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কখনো বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে দেয়নি। রংপুরেও তা-ই করবে। কিন্তু তাদের সব বাধা-বিপত্তি উপক্ষো করেই ইনশা আল্লাহ সাধারণ মানুষ এতে অংশ নেবেন। গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে খুলনার গণসমাবেশ নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের সাহসী ভূমিকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন কমিটির সদস্যরা। এ ধারা অব্যাহত রেখে সামনের কর্মসূচিগুলো সফল করার নির্দেশনা দেন দলের হাইকমান্ড তারেক রহমান।

বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির প্রধান সমন্বয়ক আসাদুল হাবিব দুলু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রংপুর বিভাগের ১০টি (সাংগঠনিক জেলা) ইউনিটেই সমাবেশ করেছি। জেলার ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত প্রস্তুতি সভা করেছি। পাড়া-মহল্লায় সভা চলছে। সমাবেশ শতভাগ সফল হবে। অতীতের সমাবেশগুলোতে সরকারের বাধা-বিঘ্ন মোকাবিলার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের নেতা-কর্মীসহ সাধারণ জনগণ বিকল্প পথ ধরে সমাবেশ স্থলে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রয়োজনে নদী সাঁতরে হলেও সমাবেশে যোগ দেবেন তারা। ‘দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা’ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০১৩ সালে বিভাগীয় সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রংপুর এসেছিলেন। তখন বলা হয়েছিল- সংগঠন দুর্বল, সমাবেশ সফল হবে না। দেখা গেছে, রংপুর বিভাগের সমাবেশ শতভাগ সফল হয়েছিল। ২৯ অক্টোবরের সমাবেশও আশাতীতভাবে সফল হবে। রংপুর বিভাগীয় সমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির সদস্য আমিনুল ইসলাম বলেন, সমাবেশের দিনই প্রমাণ হবে- রংপুরে বিএনপি এখন কতটা শক্তিশালী। তিনি বলেন, সমাবেশ সফল করতে ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, ‘রংপুর জাতীয় পার্টির ঘাঁটি’ সেই পরিবেশ এখন আর নেই। দ্রব্যমূল্য মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ফলে আওয়ামী লীগের প্রতিও মানুষ চরম বিরক্ত। রংপুরের জনগণ এখন বিএনপির পতাকাতলে সমবেত হচ্ছেন।

রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মাহফুজ উন নবী ডন এ সম্পর্কে বলেন, নেতা-কর্মীদের হুমকি-ধমকি দেওয়া শুরু হয়েছে। আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা চলছে। তারপরও চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনা বিভাগের চেয়ে বড় সমাবেশ হবে এই রংপুরে। রংপুর বিভাগের ১০টি সাংগঠনিক জেলা থেকে নেতা-কর্মীরা যে কোনো মূল্যে এতে অংশ নেবেন।

রংপুরের গণসমাবেশ নিয়ে কৌশলী বিএনপি : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ ভোলায় নূরে আলম ও আবদুর রহিম, নারায়ণগঞ্জে শাওন, মুন্সীগঞ্জে শহিদুল ইসলাম শাওন, যশোরে আবদুল আলিম এই পাঁচজনকে হত্যার প্রতিবাদ এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার, দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তি ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দাবিতে সারা দেশে বিভাগীয় পর্যায়ে গণসমাবেশ করছে বিএনপি। তারই অংশ হিসেবে আগামী শনিবার রংপুরের এই গণসমাবেশ। দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশনায় যে কোনো মূল্যে সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছেন সংশ্লিষ্ট নেতা-কর্মীরা। বিভাগের সব জেলায় প্রস্তুতি বৈঠকের পর উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রস্তুতি সভা করা হচ্ছে। প্রচারণা চলছে পাড়া-মহল্লায়। অন্য সমাবেশে কী ধরনের বাধা এসেছিল, সেসব বিষয় মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। সমাবেশের আগে চট্টগ্রাম, খুলনা ও ময়মনসিংহের মতো যদি বাস বন্ধ থাকে- সে ক্ষেত্রেও করণীয় ঠিক করে রেখেছেন নেতারা। রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম বলেন, শহরের কালেক্টরেট (ঈদগাহ মাঠ) ময়দানে রংপুর বিভাগীয় গণসমাবেশের অনুমতি পেয়েছি। এরই মধ্যে সর্বত্র পোস্টার, ব্যানার সাঁটানো হয়েছে। মাইকিং ও প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে। এখন পাড়া-মহল্লায় প্রস্তুতি বৈঠক সম্পন্ন করা হচ্ছে। ফলে কোনো ধরনের বাধাই এখন আর কাজে আসবে না।

মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু বলেন, গণসমাবেশ সফল করতে বিএনপি নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে রংপুর শান্তিপ্রিয় স্থান। এখানে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। এখানে সব রাজনৈতিক দলের শান্তি বজায় রাখার ইতিহাস রয়েছে। তারপরও কেউ বাধা দিলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। রংপুর জেলা যুবদলের সভাপতি নাজমুল আলম নাজু বলেন, গণসমাবেশ সফল করতে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। সমাবেশে কমপক্ষে পাঁচ লক্ষাধিক লোক সমাগম হবে। কোনো বাধাই এই সমাবেশ ঠেকাতে পারবে না।

‘চলো চলো রংপুর চলো’ : এদিকে রংপুরের বিভিন্ন স্থানে ‘চলো চলো রংপুর চলো’ স্লোগানে একটি পোস্টার লাগানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গণসমাবেশে প্রধান অতিথি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিশেষ অতিথি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। গণসমাবেশকে ঘিরে ছাপানো রংপুরে এই পোস্টারটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে বলে জানা গেছে।

 

 

সর্বশেষ খবর