ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে দেশের দক্ষিণের উপকূলকে রক্ষায় এবারও বুক পেতে দিয়েছে সুন্দরবন। শক্তিশালী বাতাসের তান্ডবে বন বিভাগের বিভিন্ন ক্যাম্পের ছয়টি কাঠের জেটি, পাঁচটি পন্টুন, মাটির রাস্তা ও তিনটি পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হলেও উপকূলের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার ও তুলনামূলক টেকসই বেড়িবাঁধের কারণে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে।
আবহাওয়া দফতরের তথ্যমতে, ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। প্রবল বাতাসের সঙ্গে কয়েক ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসও তৈরি হয়। কিন্তু একই শক্তির ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, আম্ফানে উপকূলে যে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এবার সে তুলনায় ক্ষতি কম হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন জানান, বন বিভাগের পাটকোষ্টা, গেওয়াখালী, শিবসা, আধাছাই, পাশাখালী ও ভদ্রা ক্যাম্পের ছয়টি কাঠের জেটি ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নোটাবেকি, মুন্সীগঞ্জ, পুষ্পকাঠি, কলাগাছিয়া ও দোবেকি পন্টুন। বনের ভিতরে তিনটি মিঠাপানির পুকুর ও মাটির রাস্তাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ৬০-৮০ কিলোমিটার গতিতে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার কথা ছিল। কিন্তু আশ্চর্যভাবে দেখা যায়, যখন ঘূর্ণিঝড় বঙ্গোপসাগর থেকে সুন্দরবনে প্রবেশ করে তখনই এর গতিবেগ কমে যায়। সুন্দরবনে প্রায় ৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার গাছপালার ‘শেল্টার বেল্ট’-এ বাধাগ্রস্ত হয়ে বাতাসের গতি কমে যায়। এতে বিস্তীর্ণ জনপদে ক্ষতি কম হয়েছে। জানা যায়, উপকূলীয় এলাকায় তুলনামূলক টেকসই বেড়িবাঁধ, দুই দিন আগে থেকে সতর্কতা মাইকিং, মানুষকে সাইক্লোন শেল্টারে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ায় এবার প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়েই কয়রার হরিণখোলা বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। কিন্তু ২০২০-২০২২ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এখানে টেকসই ‘চাকলা ক্লোজার ও রিং ডাউক’ নির্মাণ করা হয়। এবার ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে সেই বাঁধে ফাটল তৈরি হলেও পুরোপুরি ভেঙে না যাওয়ায় ফসলের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে এখানকার মানুষ। কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম জানান, কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপের ৮ হাজার মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে নির্ঘুম রাত কাটান। ঘূর্ণিঝড়ে এই তিন উপজেলায় দেড় হাজারের বেশি কাঁচাঘর বিধ্বস্ত হলেও প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, মূলত এখানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১০-১২টি পয়েন্টে বাঁধ নাজুক অবস্থায় আছে। কিন্তু এর পরও আগের তুলনায় বাঁধের উন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া আগে মানুষ এত সচেতন ছিল না। ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে রোধ করা যায় তারা তা জানত না। কিন্তু সরকারি ও এনজিও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনগণ, সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা অনেক সচেতন হয়েছেন। এদিকে দুর্যোগ মোকাবিলায় উপকূলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে আরও আধুনিকায়ন ও ‘প্রাকৃতিক ঢাল’ সুন্দরবন রক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন বন গবেষক ও সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বনাঞ্চল যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অর্জন থাকলেও ঘাটতির নানা দিক রয়েছে। তাই আত্মতুষ্টির ঢেকুর না তুলে সুন্দরবন রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে আরও আধুনিকায়ন করতে হবে।