মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

এখনো বাস্তবায়ন হয়নি রায়ের সব নির্দেশনা

বিচার বিভাগ পৃথককরণের ১৫ বছর

আরাফাত মুন্না

আজ ১ নভেম্বর। বিচার বিভাগ পৃথক্করণ দিবস। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে ২০০৭ সালের এই দিনে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয় বিচার বিভাগ। ওই রায়ে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের লক্ষ্য পূরণে অধস্তন আদালতের বিচারকদের

 পদোন্নতি-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নসহ ১২ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। পৃথক্করণের ১৫ বছর পরেও বাস্তবায়ন হয়নি ওই রায়ের সব নির্দেশনা। আইনজ্ঞরা বলছেন, রায়ের নির্দেশনাগুলো সব বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার সুফল এখনো পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না। বরং মামলাজট বেড়েছে।

১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা-সংক্রান্ত মাসদার হোসেন বনাম সরকার মামলার যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেন সর্বোচ্চ আদালত। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে ৩০১ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা নিয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ১ হাজার ৯৫০ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। একই সঙ্গে পৃথক্করণের সময় দেশের সব আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। অন্যদিকে গত ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪১ লাখ ৯৮ হাজার ৫৫৩টি। মানে এ ১৫ বছরে মামলাজট বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা বিচার বিভাগের সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ করছি।’ তিনি বলেন, ‘সরকার মামলাজট কমানোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তা কমানোর জন্য নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিচারকাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে এবং এজলাস সংকট নিরসনে বেশকিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্যও এসেছে।’ আইন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী সরকার ইতোমধ্যে অধস্তন আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য পৃথক জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠন করেছে। এর আওতায় এ পর্যন্ত ১৩টি পরীক্ষা হয়েছে। বর্তমান সরকারের টানা তিনটি মেয়াদে ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অধস্তন আদালতে প্রায় ১ হাজার ১০০ জন সহকারী জজ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২০০৭ সালের আগে সরকারি কর্মকমিশনের আওতায় বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী জজ পদে নিয়োগ দেওয়া হতো। এ ছাড়া দেশের ৬৪ জেলায় অধস্তন আদালতের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ, বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, স্বতন্ত্র পে-স্কেল প্রণয়ন, কয়েকটি স্তরে গাড়ি সুবিধা দেওয়াসহ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বেড়েছে বিচার বিভাগের জন্য বাজেট বরাদ্দও। তবে এখন পর্যন্ত বিচার বিভাগের বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা আইন মন্ত্রণালয়ের হাতেই রয়েছে বলে জানা গেছে। মাসদার হোসেন মামলার রায়ে এ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে থাকার কথা ছিল। এ ছাড়া রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয়ও গঠন হয়নি ১৫ বছরে। জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘১৫ বছর আগে যে বিষয়টি নিয়ে বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছিল, সেই একই সমস্যা এখনো রয়েছে গেছে। মামলাজট যেন কমানোই যাচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাসদার হোসেন মামলায় যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তার কিছু কিছু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা জরুরি। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলেই বিচার বিভাগ প্রকৃতভাবে স্বাধীন হবে।’

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর কোনো সরকারই বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করছিল না। পরে ২০০৭ সালে তৎকালীন সেনাসমর্থিত সরকার পৃথক্করণের কাজটি করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম এর মাধ্যমে বিচার বিভাগ পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে। তবে বাস্তবে তা হয়নি। এখনো বিচারকদের পদায়ন, বদলিসহ অনেক সিদ্ধান্তেই আইন মন্ত্রণালয়ের কাজ করতে হয়। মন্ত্রণালয়ই মূলত ফাইল প্রস্তুত করে থাকে। যদি বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় থাকত তাহলে এ কাজগুলোও বিচার বিভাগই করত।’

যা আছে সেই ১২ দফায় : নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের যে ঐতিহাসিক ১২ দফা নির্দেশনা ছিল, তা হচ্ছে- এক. সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সব বিভাগের কাজ সার্ভিস অব রিপাবলিকের ভিতরে পড়বে। তবে বিচার বিভাগের কাজ ও অবকাঠামোর সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসের অনেক ভিন্নতা রয়েছে। বিচার বিভাগকে অন্যান্য সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে একত্র করা যাবে না। দুই. বিচারিক (জুডিশিয়াল) ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করতে হবে এবং নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারিক কাজ করতে পারবেন না। সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের পদ সৃষ্টি, নিয়োগ পদ্ধতি, নিয়োগ বদলিসহ অন্যান্য কাজের বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারবেন। তিন. সিভিল সার্ভিস অর্ডার, ১৯৮০ অনুযায়ী সব ম্যাজিস্ট্রেটকে পিএসসির অধীনে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয়। একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থী। চার. এ রায় পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা এবং কমিশন গঠন করতে হবে। এ কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। এ কমিশনে নারী ও পুরুষ বলে কোনো বৈষম্য থাকবে না। পাঁচ. সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়ারি সবার চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন। ছয়. সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করবেন। সাত. সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে। আট. বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ সব বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। নয়. জুডিশিয়ারির (নিম্ন আদালত) বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো হাত থাকবে না। এ বাজেট সুপ্রিম কোর্ট প্রণয়ন ও বরাদ্দ করবেন। দশ. জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা প্রশাসনিক আদালতের আওতাভুক্ত থাকবেন।

এগারো. এ রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগ পৃথক্করণের জন্য সংবিধানে কোনো সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। তবে পৃথক্করণ আরও অর্থবহ করতে যদি সংবিধানের সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তবে তা করা যাবে। বারো. জুডিশিয়াল পে-কমিশন জুডিশিয়ারির সদস্যদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ না করবে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবকাঠামো অনুযায়ী তারা সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।

সর্বশেষ খবর