ইউক্রেন ও রাশিয়ার চলমান যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম রেকর্ড ভেঙেছে, যার প্রভাব বাংলাদেশের বাজারেও পড়ছে। ভর্তুকি কমাতে এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। তারপরও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) দৈনিক প্রায় ৮ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। এই অঙ্ক প্রতি মাসে প্রায় ২৪০ কোটি টাকা। বিপিসি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সুবিধাটি ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি ডলারে ১০-১২ টাকার যে অবমূল্যায়ন হয়েছে, এতে বিপিসির ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। যার কারণে এখনো লোকসানের মধ্যে আছে সংস্থাটি।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে লোকসান হয় ৫ হাজার কোটি টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধ করার জন্য বিপিসিকে দুই মাসের জ্বালানি তেলের মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ (২৫% বৃদ্ধিসহ) চলতি মূলধন হিসেবে রাখতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বাড়লে বিপিসির মূলধনও বাড়াতে হয়। ২০২০-২১ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল তুলনামূলক সহনশীল থাকায় ওই সময় বিপিসির ১২ হাজার কোটি টাকা চলতি মূলধন রাখা হতো। এখন রাখা হচ্ছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় এখন দেশেও দাম কমানোর দাবি তুলছেন অনেকেই। এ অবস্থায় যদি জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয় তাহলে বিপিসির লোকসান আরও বেড়ে যাবে। লোকসানে থাকা বিপিসি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না বলে জানান বিভাগ-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ‘লোকসানে থাকা বিপিসিকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে সামনে জ্বালানি বাজার আবার অস্থির হয়ে উঠলে বিপিসির পক্ষে তখন সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘যেহেতু বিপিসি ডিজেলে এখনো কিছুটা লোকসান দিচ্ছে, তাই এই মুহূর্তে দাম কমানোর যৌক্তিকতা নেই। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে যে পরিমাণ পরিবহন ভাড়া বেড়েছে, এখন দাম কিছুটা কমানো হলেও পরিবহন ভাড়া কমবে না। এতে মানুষ কোনো সুবিধা পাবে না। এর চেয়ে ভালো সরকার আয় করুক, যাতে পরবর্তীতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে ভর্তুকি হিসেবে দিতে পারে। তিনি বলেন, তবে এই টাকা অন্য খাতে যেন ব্যবহার করা না হয়। তবে সরকার চাইলে অকটেন ও পেট্রোলে দাম কমাতে পারে।
বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় প্রায় এক বছর পর্যন্ত বিপিসির নিজস্ব তহবিলের টাকায় ভর্তুকি দিয়ে তেল বিক্রি করা হয়। এতে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা টাকা থেকে ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিতে হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমেছে, তবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে তেল আমদানিতে খরচ বেশি পড়ছে। যার কারণে বিপিসি এখনো লোকসানের মধ্যেই আছে। তবে জ্বালানি তেলের দাম কমায় বিপিসির লোকসানের মাত্রা কিছুটা কমে এসেছে, কিন্তু আমরা এখনো লোকসানমুক্ত হতে পারিনি।
বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখন প্রতি লিটার ডিজেলে আমাদের লোকসান হচ্ছে ৪-৫ টাকা। যা গত দেড়-দুই মাস আগেও লিটারে ৮-১০ টাকা পর্যন্ত লোকসান ছিল। এখন বিপিসির দৈনিক লোকসান হচ্ছে প্রায় ৮ কোটি টাকা। তবে ফার্নেস অয়েল, পেট্রোল, অকটেন বিক্রিতে লোকসান নেই। গত আগস্ট মাসে ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর থেকে ডিজেল বিক্রিতে এখনো লোকসান দিতে হচ্ছে।’ বিপিসির চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘বিপিসিকে যদি ব্রেক ইভেন পয়েন্টে রাখতে হয় তাহলে বিশ্ববাজারে পরিশোধিত ডিজেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১০৪ ডলারে আসতে হয়। এখনো প্রতি ব্যারেল পরিশোধিত ডিজেলের দাম প্রায় ১০৮-১০৯ ডলার।’
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৭০-৭২ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ডিজেলের চাহিদা ৪৮-৪৯ লাখ মেট্রিক টন। এখন দৈনিক গড়ে ডিজেল বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেট্রিক টন।