রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সাত সংকট কাটাতে চার সুপারিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সাত সংকট কাটাতে চার সুপারিশ

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে সাত রকমের সংকট রয়েছে। এগুলো হলো- ডলার সংকট, জ্বালানির দর, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, খাদ্য সংকটের শঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনা-পরবর্র্তী অবস্থা। এসব সংকট কাটাতে সরকারের প্রতি চার ধরনের সুপারিশ করেছে সিপিডি। সুপারিশগুলো হলো- পণ্য আমদানিতে কর রেয়াতের সুযোগ রয়েছে, যা বাতিল করা যেতে পারে। এককভাবে বা কয়েকজন মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, যা এক ধরনের শক্তিশালী সিন্ডিকেট, এসব সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। ন্যূনতম মজুরি/বেতন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আয় কমে যাওয়ার কারণে জীবনযাত্রায় তীব্র সংকট বিরাজ করছে। এ সংকট কাটাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্য সংকট এড়াতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। সারের উচ্চমূল্যের কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। কৃষি খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা রয়েছে। এ জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। গতকাল রাজধানীর ব্র্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত ‘সংকটে অর্থনীতি : কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে?’ শীর্ষক এক সংলাপে এসব সুপারিশ তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, বার্জার পেইন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুপালী হক চৌধুরী, ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রহমান। এতে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির চেয়ারম্যান প্রফেসর রেহমান সোবহান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা ও মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, অর্থমন্ত্রী অর্থনীতি চালান না, অর্থনীতি পরিকল্পনামন্ত্রী বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর চালান না। অর্থনীতি বাই রুল বাই অর্ডার চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এটাই আইন, কারণ উনি (প্রধানমন্ত্রী) সরকারপ্রধান। তাঁর থেকে এসব আইন মেনে আসে। আমি হয়তো আজ অসুস্থ বা অন্য কেউ অসুস্থ হলেন, আমি হয়তো অফিসে গেলাম না। তাই বলে কাজ তো আর পড়ে থাকবে না। আমি বলতে চাই, আমরা জেনেশুনেই অর্থনীতি চালাচ্ছি। আমরা কিছু পন্ডিতের সঙ্গে কাজ করে এগুলো শিখেছি। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আমি একটা গ্রামীণ এলাকা হাওরের প্রতিনিধিত্ব করি। আমি প্রতি সপ্তাহে হাওরে যাই, সেখানে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলি। হাট-বাজারে চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সাধারণ জনগণের সঙ্গে কথা বলি। বর্তমান সরকার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে। আগে যেভাবে চালের হিসাব করতে দেখেছি এখন তা নেই। যে গ্রামে আমি সাঁতরে স্কুলে গেছি, এখন বাচ্চারা মোটরসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। আপনারা কালো মেঘ দেখছেন, আমরা সিলভার লাইটিং দেখছি। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আমার মন্ত্রণালয়ের কাজ এটা নিরূপণ করা। মূল্যস্ফীতি কমছে, তবে নিম্ন হারে। এতে মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে। বিবিএস সঠিক নয়, এটা কেউ বললে তার সঙ্গে আমি বিবাদে যাব। আমরা সংখ্যা নিয়ে অসত্য কথা বলি না। আমাদের ফিগার বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও স্বীকার করেছে। সিপিডির মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা কভিড কিংবা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে নয়। এই খাত দীর্ঘদিন ধরে দুর্বলতার মুখোমুখি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, বিভিন্ন সূচকে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। দুর্বল সুশাসন ও সংস্কারের অভাবে এই খাত ক্রমান্বয়ে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এর উন্নতি না হলে ব্যাংকগুলোতে মূলধনের ঘাটতি রয়েই যাবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এই নাম্বার সবার মুখস্থ। বাস্তবে যেটা দেখানো হয়, খেলাপি ঋণের পরিমাণ তার চেয়েও বেশি। এটা অর্থনীতিবিদরা এবং আইএমএফ বলছে। এর ভিতরে যদি আরও বেশ কিছু আনা হয়, ঋণের পরিমাণটা বেশি হবে। স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট, লোন যেগুলো রয়েছে কোর্ট ইনজাকশনের মধ্যে এগুলো হিসাব দেওয়া হলে সেটা দ্বিগুণের বেশি হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক, আইন ও তথ্যগত দুর্বলতার কারণে ব্যাংক খাতে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। এতে আরও বলা হয়, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ কম খাচ্ছে। অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ জাতীয় খাবার। রাজধানীর চার সদস্যের পরিবারের খাবারের পেছনে মাসে গড়ে খরচ ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা। প্রফেসর রেহমান সোবহান প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন, আমাদের সিস্টেমে সিরিয়াস প্রবলেম। নীতিনির্ধারকদের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। সেখানে কাজ করতে হবে। অর্থনীতির ভিতরে সংকট রয়েছে। এটা একক সংকট নয়। এখানে সবচেয়ে বড় সংকট হলো সিস্টেমেটিক প্রবলেম। সেটা সিরিয়াস প্রবলেম। এখানে আমাদের কাজ করতে হবে।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি একই সঙ্গে বাড়তে পারে না। অথচ গত কয়েক বছর ধরে জিডিপি ও মূল্যস্ফীতি একই সঙ্গে বাড়ছে। এটা অবশ্যই একটা সমস্যা। এখানে সাপ্লাই ও ডিমান্ডের মধ্যে বড় সমস্যা রয়েছে। এখানে একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার যে, কোনো ঝড় আসার আগে পরিবেশ খুব শান্ত থাকে। এখানে আমাদের পরিবেশের সঙ্গে বর্তমানে একটা মিল পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংক খাতের সমস্যা তো বেড়েই চলেছে। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকই নয়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বেজা, বিডা, জয়েন স্টক কোম্পানি, ইপিবি এসব প্রতিষ্ঠানের কিছু জায়গায় সংস্কার করা খুবই জরুরি। খেলাপি ঋণ কমছে না। এখানে এ ধরনের নীতিবিভ্রাট রয়েছে। নীতির পরিবর্তন করা জরুরি। বাংলাদেশ বছরে একটা মুদ্রানীতি ঘোষণা করে ঘরে বসে থাকে। এমনকি এটা একটা নজিরবিহীন ঘটনা যে, হোটেলে বসে মূল্যস্ফীতি ঠিক করা হয়। ভারতে তো প্রতি তিন মাস পর পর মুদ্রানীতি ঠিক করা হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল রিজার্ভ তো প্রতি সপ্তাহেই এসব নীতির পরিবর্তন করে। অথচ আমরা তা করি না। ব্যাংকের বোর্ডে কী হচ্ছে? আমরা যে ধরনের পরিবর্তন এনেছি সেটা তো আরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে একই ব্যাংকে একই পরিবারের আধিপত্য যা ছিল সেটা আরও বাড়ানো হয়েছে। খেলাপি ঋণ কমানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগই নেই। এখানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানাশোনা লোকদের কথাও শোনা হয় না। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো-সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। এখানে ক্ষমতার ব্যবহার করা হয় দুর্বলদের ওপর। দুভাবে এই ক্ষমতার ব্যবহার হয়, এর একটি হচ্ছে বাধা তৈরি করা এবং পথের বাধা সরিয়ে ফেলা।

সর্বশেষ খবর